ইন্দোনেশিয়া সম্প্রতি চীনের তৈরি নতুন অস্ত্র, বিশেষ করে জে-১০ যুদ্ধবিমান কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। এই আগ্রহ কেবল আরেকটি আন্তর্জাতিক অস্ত্রচুক্তির বিষয় নয়; বরং এটি বিশ্ব অস্ত্রবাজারে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে।
চীনের জন্য দ্রুত বিস্তৃত প্রতিরক্ষা শিল্পে নতুন ক্রেতা পাওয়া তার বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি বেইজিংয়ের সামরিক আধুনিকায়নে নতুন আর্থিক শক্তি যোগাবে।
ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য কোনো অস্ত্রচুক্তি হলে তা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির এক বড় ধাপ হয়ে উঠবে, কারণ এটি অন্য দেশগুলোকেও চীনের দিকে ঝুঁকতে উৎসাহিত করতে পারে।
অপ্রত্যাশিতভাবে পাকিস্তান চীনের অস্ত্রবাজারে নতুন গতি এনে দিয়েছে।
পাকিস্তানের চীনা অস্ত্র ব্যবহার
এ বছরের মে মাসে পাকিস্তান চার দিনের সংঘাতে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সফলভাবে চীনা সরঞ্জাম ব্যবহার করে। পাকিস্তান চীনা সরবরাহকৃত জে-১০ যুদ্ধবিমান এবং চীনা PL-15 আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ভারতের ফরাসি নির্মিত দাসো রাফাল যুদ্ধবিমানকে টার্গেট করে।
দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন দাবি থাকা সত্ত্বেও স্পষ্ট যে পাকিস্তান চীনা অস্ত্র ব্যবহার করে কিছু রাফালকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। এর ফলে রাফাল যুদ্ধবিমানের ‘অজেয়’ ভাবমূর্তি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই সংঘাতের পর থেকেই জে-১০ ও অন্যান্য চীনা অস্ত্রের ভবিষ্যৎ সংস্করণ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চীনের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির দুটি কারণ
প্রথমত, চীনা অস্ত্র এখনো পশ্চিমা সরবরাহকারীদের তুলনায় সস্তা। পার্থক্য কমেছে বটে, কিন্তু তা এখনো অনেক দেশকে আকৃষ্ট করে। এমনকি চীন দীর্ঘমেয়াদি কিস্তি বা সহজ শর্তে পরিশোধের সুযোগও দেয় বলে জানা যায়।
দ্বিতীয়ত, চীনের অস্ত্র উৎপাদন প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে। একসময় নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে যে সন্দেহ ছিল, এখন তা অনেকটাই দূর হয়েছে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চীন কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাজনৈতিক স্বার্থে অস্ত্র বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করে না। পাকিস্তান তার অভিজ্ঞতা থেকেই এটি ভালোভাবে বুঝেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতির উলটপালট থেকে শিক্ষা
১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পরও পাকিস্তানে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে পাকিস্তান দ্রুত পারমাণবিক সক্ষমতার দিকে এগোচ্ছিল।
কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা পাকিস্তানকে আটকাতে পারেনি। ১৯৯৮ সালে ভারত পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর পর পাকিস্তানও তা অনুসরণ করে এবং পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের তালিকায় যুক্ত হয়।
২০০১ সালে নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ওপর সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং নতুন করে মিত্রতার প্রয়োজন অনুভব করে।
এই নাটকীয় নীতিগত পরিবর্তন পাকিস্তানকে চীনের সহযোগিতায় নিজস্ব সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে আরও উৎসাহিত করে।
চীনের সহায়তায় পাকিস্তান জেএফ-১৭ থান্ডার যুদ্ধবিমান তৈরি করে, যা এখন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রধান শক্তি। পাশাপাশি দেশটি যুদ্ধবিমানটি বিদেশেও রপ্তানি করছে। আজারবাইজানের অর্ডার প্রথমে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের হলেও পরবর্তীতে তা ৪.৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে বৈশ্বিক সন্দেহ
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত বিভাজন এবং গাজায় দুই বছর ধরে চলা সহিংসতায় ইসরায়েলকে প্রকাশ্য সমর্থন বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ৭০,০০০ ফিলিস্তিনির হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনা ভবিষ্যতে কতটা নিরাপদ—তা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে।
কারণ যুক্তরাষ্ট্র বহুবার অস্ত্র বিক্রিকে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলে অনেক দেশ এখন বিকল্প অস্ত্রসরবরাহকারী খুঁজছে।
ইন্দোনেশিয়ার কৌশলগত সিদ্ধান্ত
ইন্দোনেশিয়া মনে হচ্ছে তার সামরিক সরঞ্জামের উৎস বৈচিত্র্যময় করতে চাইছে এবং আগের মতো শুধুমাত্র পশ্চিমা বা অ-চীনা উৎসের ওপর নির্ভর করতে চাইছে না।
ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক শর্তের ইতিহাস জাকার্তার নীতিনির্ধারকদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। সেই কারণে তারা আধুনিক যুদ্ধবিমান কেনার ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের দিকে বেশি ঝুঁকছে।
এই প্রেক্ষাপটে চীনা অস্ত্র ইন্দোনেশিয়ার কাছে শুধু সাশ্রয়ী বা প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত নয়—বরং রাজনৈতিকভাবে নিরাপদও মনে হচ্ছে।
লেখক: ফারহান বুখারি ইসলামাবাদভিত্তিক এক বিদেশি সংবাদদাতা, যিনি পাকিস্তান ও তার আশপাশের অঞ্চল নিয়ে লিখে থাকেন।
চীন_অস্ত্র ইন্দোনেশিয়া_চুক্তি পাকিস্তান_চীন আন্তর্জাতিক_রাজনীতি যুদ্ধবিমান
ফারহান বুখারি 


















