মানুষের সব আশা পূরণ হয় না। এই না হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমন মনে করিয়াছিলাম গোটা তিনেক ইংরেজি উপন্যাস লিখিব। মাইকেল মধুসূদন সফল হননি তাহাতে কী হইয়াছে, অমিতাভ ঘোষ তো নোবেল প্রাপ্তির সিঁড়িতে গিয়া দাঁড়াইয়াছেন। নোবলে তিনি নাই পান, ক্ষতি নাই। তাহার নতুন উপন্যাস প্রকাশ কবে হইবে এই জন্য অনেকেই অপেক্ষা করিয়া থাকেন। ইহা একজন লেখকের জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কার নহে কি?
সেখানে একটু ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া দেখিলে কি খুবই ভুল হইবে—ইহা ভাবিয়া Sunday Syndromes নাম দিয়া একখানি উপন্যাস লিখিতে শুরু করিয়াছিলাম।
কিন্তু আজ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা নকল করিয়া বলিতে হয়, আমার এই অগোছালো জীবনের এই প্রান্তে আসিয়া দেখিতে পাইতেছি চিত্র ভিন্ন। ফুল স্কেপ কাগজের ১৭০০ পৃষ্ঠা বাংলা উপন্যাসের একটি পাণ্ডুলিপি এক প্রকাশকের ড্রয়ার হইতে যে কোথায় চলিয়া গিয়াছে তাহা জানিবার কোন উপায় নাই। সানডে সিন্ড্রোমস এর পাণ্ডুলিপি যে পোর্টেবল হার্ড ডিস্কে রাখিয়াছিলাম তাহা খুঁজিয়া পাইবার আশা কম।
বাস্তবে আমাদেরকে ডেড পোয়েটের মতো ডেড লেখক বলিয়া থাকে। ইহাতে কষ্ট পাইবার কিছু নাই। যেমন জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়া গিয়াছে নানান আড্ডায়। তাহা লইয়া অনেক কিছুই লিখিতে ইচ্ছা পোষণ করিয়াছি। মাঝে মাঝে কম্পিউটার বা টাইপ রাইটারে বসিয়াছি। ব্যস, তাহার পরে দ্রুতই ওই চ্যাপ্টার বন্ধ হইয়া গিয়াছে।
সিনেমার রিলের মতোই আরেকটি দৃশ্য জীবনের পর্দায় আসিয়া হাজির হইয়াছে। তখন তাহা লইয়াই সময় কাটাইতে হইয়াছে। ওই যে আড্ডার কথা উল্লেখ করিয়াছি, ওই আড্ডাগুলিকে ভাগ করিয়া কয়েকটি বই লিখিবার ইচ্ছা ছিলো। তাহার ভিতর একটি “সাগর পাবলিশার্সের সেই কথাগুলো”।
এম আর আখতার মুকুলের সাগর পাবলিশার্স একটি বুক শপ হইলেও মূলত তাহা ছিলো নানান মুনীর নানান মত প্রকাশ করিবার একটি আড্ডাখানা। সেই সব দৃশ্যগুলি কখনও কখনও ছবির মতো চোখের সামনে ভাসিয়া ওঠে।
যেমন শওকত ওসমান স্যার বহুদিন “পাকিস্তানী চরিত্র” লইয়া কথা বলিয়াছেন। আজ তাহার কিছুটা মনে পড়িলে শিহরিয়া উঠি। আসলে তিনি যাহা বলিতেন, যদি প্রকৃত সাংবাদিক বা লেখক হইতাম- তাহা হইলে আড্ডায় না মাতিয়া নোটবুকে দ্রুত গতিতে হাত চালাইতাম। আজ সেইগুলি লইয়া অনেক বড় কিতাব লিখিতে পারিতাম। বলিয়া ফেলিলাম—লিখতে পারিতাম। তবে সত্য বলিতেছি পারিতাম না। ওই বিদ্যে পেটে নাই।
তিনি পাকিস্তানী চরিত্র ব্যাখ্যা করিতে গিয়া বলিতেন, পাকিস্তানী চরিত্র, পাকিস্তান হইতে ভাগ হইয়া আসিবার পরেও তোমার মধ্যে থাকিতে পারে। তাহার ভাষায় পাকিস্তানী চরিত্র অর্থাৎ “বেশ্যার চরিত্র”। ইহা লইয়া তাহার একটি “শেখের সম্বরা”ও আছে। তিনি শেষের দিকে ছোট ছোট ছড়া লিখিতেন, যাহাকে “শেখের সম্বরা” বলিতেন।

পরে ওই নামে বই আকারে বাহির হইয়াছে সেই সম্বরাগুলো। তবে তাহা কোন মতেই সবগুলো নহে। কারণ, পথে ঘাটে আমাদের মতো তাঁহার স্নেহভাজনদের সঙ্গে দেখা হইলেই তিনি ব্যাগ হইতে কিছুক্ষণ আগে যে সম্ভার বা ছড়া বা শ্লোকটি লিখিয়াছেন তাহা বাহির করিয়া নিজহাতে সই করিয়া উপহার দিতেন।
সেদিন দেখিলাম, বাংলা একাডেমী হইতে কেজি দরে বিক্রি হওয়া বইয়ের ভেতরে—শহীদুল্লাহ কায়সারের সই করা বই । সে বই লাখ টাকায় বিক্রি হইয়াছে। তখন কেবল মনে হইলো, কবি আল মাহমুদের কবিতার সেই বাণী—পক্ষী কূলে জন্ম লইয়াও উড়াল শিখিলাম না।
কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরি, কালাম মাহমুদ, মুর্তজা বশির প্রমূখ বিভিন্ন সময়ে তাহাদের সামনের টেবিলে রাখা কাগজ ও পেন্সিল দিয়া কত স্কেচ করিয়াছেন। কখনও কখনও সই করিয়াছেন। আবার ফেলিয়া দিয়াছেন। সেগুলো ভালো লাগিত। কুড়াইয়া আনিতাম—কখনও হাসিমুখে নিজ হাতে দিতেন। আর মুর্তজা বশির ভাই যে “মূর্ত ও বিমূর্ত মুর্তজা বশির” নামে আত্মজীবনী লিখিবেন বলিয়া প্রস্তুতি লইতেছিলেন—সেই সময়ে ওই না লেখা বইয়ের প্রচ্ছদের স্কেচ নিউজ প্রিন্টে বহুবার করিয়াছেন। আর সেগুলো তখন ভালো লাগার ফলে কুড়াইয়া লইয়াছি। কিন্তু বুঝিতে তো পারি নাই লাখ টাকা দাম হইবে। যাক, টাকা নাইবা হোক, ওই স্কেচগুলি ও তাহার সৃষ্টির শুধু আমরা সাক্ষী নই—তাহার চাইতে বড় হইলো, তাহারা কিছুটা আমাদের চোখের দৃষ্টি খুলিয়া দিয়াছিলেন বলিয়া; আজ পৃথিবীর যে কোনো বড় আর্ট গ্যালারিতে যাইবার সুযোগ পাইলে বড় লাঞ্চ ত্যাগ করিয়াও চলিয়া যাইতে পারি।
সাগর পাবলিশার্সে বসিয়া শওকত ওসমান স্যারের কাছে পাকিস্তানি চরিত্র কী তাহা বুঝিয়াছি বলিয়া আজও অনেক উঁচু উঁচু মানুষকেও বুঝিতে কষ্ট হয় না। তিনি তাহার চমৎকার প্রমিত বাংলা উচ্চারণে বলিতেন, বেশ্যাকে যেমন বেশ্যা সর্দারনীর বা তার নিযুক্ত “মাসি”-র নির্দেশে যখন তখন যাহার কাছে যৌবন বিলাইয়া দিতে হয়, তেমনি পাকিস্তানী রাষ্ট্রটির চরিত্র হইলো সর্দারনি বা মূল মালিক নিযুক্ত “মাসির” কথা মতো তাহার সকল সম্পদ কমদামে বিক্রি করিতে সে বাধ্য।

তিনি বলিতেন, পাকিস্তানী হইবার ফলে এই যে চরিত্রের বীজ আমাদের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে—ইহা হইতে আজও বাহির হইতে পারিতেছি না। তিনি বলিতেন, উচ্চে ওঠা অনেক কঠিন কাজ। নিচে নামিবার কাজটি অনেক সহজ। যত সহজে বেশ্যা হওয়া যায়, তত সহজে সন্ত, সুফি হওয়া যায় না।
অন্যদিকে কথার রাজা এম আর আখতার মুকুল যখন কথা বলিতে শুরু করিতেন, তখন তাহার বুকশপের ক্রেতারাই শুধু নন, মনে হইতো বইও যেন নীরব হইয়া শুনিতেছে। যেমন ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রে বা অবরুদ্ধ দেশের মানুষ লুকাইয়া এবং শরণার্থী শিবিরের মানুষ গোল হইয়া বসিয়া তাহার “চরমপত্র” শুনিত।
এম আর আখতার মুকুলের বন্ধু শ্রেণীর মধ্যে যখন যেমন মানুষ আসিতেন তখন তাহার সঙ্গে সেই ধরনের গল্প হইতো তাহার। যেমন বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলি আসিলে তিনি খুব একটা রাজনীতির ধারে কাছে যাইতেন না। আবার শামসুল ইসলাম (সাবেক শিল্প ও তথ্যমন্ত্রী) আসিলে রাজনীতি যেন কোথা হইতে লাফ দিয়া চলিয়া আসিত।
বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলি ও শামসুল ইসলাম কোন দিন আসিবেন তাহা কখনও কখনও আগেই জানিতে পারিতাম। কারণ, এই দুই জনের কল্যাণে দুইটি নতুন দিগন্ত সব সময় পাইতাম। তখন তো আর ইন্টারনেট ছিলো না। তাছাড়া বাংলাদেশে বিদেশী বইয়ের দাম ট্যাক্স যোগ হইয়া তিনগুণ বা সাড়ে তিনগুণ হইতো। তাই এডওয়ার্ড সাঈদ ও রবার্ট ফিস্কের অনেক নতুন বই পড়িবার সুবিধাটা শামসুল ইসলাম ভাইয়ের কাছ হইতে পাইয়াছি।
বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেষ জীবনে রবীন্দ্রচর্চা করিতে গিয়া রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ভারতীয় ও ইউরোপীয় সভ্যতার বাইরে—যে পারস্য উপসাগরীয় সভ্যতা, চাইনিজ সভ্যতা ও মেকং-এর দূ কূলের সভ্যতা—ও ইন্দো-প্যাসিফিকের ইন্দোনেশীয় সভ্যতা, জাপানি সভ্যতার প্রবল প্রভাব, তাহা সত্যিই তাহাকে আমোদিত করিয়াছিলো। যাহার কারণে তিনি শেষ জীবনে মেকং এলাকার সাহিত্য, চায়নিজ লোককথা ও ফিলোসফারদের অনেক কিছুই সংগ্রহ করিতেন। তাহা হইতে কিছু আস্বাদন করিবার সুযোগ তাহার সঙ্গে গভীরতর সম্পর্ক থাকার কারণে হয়। আমাদের এই সুযোগ পাইয়া যে খুব লাভ হইয়াছে তাহা নহে। কারণ আমরা অমন পাত্র নই।
যাহাই হোক, বিচারপতি হাবিবুর রহমানের স্বভাব ছিলো খুব আস্তে আস্তে এম আর আখতার মুকুলকে উসকে দিয়া তাহার কথা শোনা। দুই বন্ধুর একজন যখন নীরব শ্রোতা হইয়া যাইতো তখন একটা ভিন্ন আমেজ নামিয়া আসিত সাগর পাবলিশার্স নামক ছোট্ট বুকশপটিতে।

যাহাই হোক “সাগর পাবলিশার্সের সেই কথাগুলো” আর এ জীবনে লেখা হইবে কিনা জানিনা, তবে এ পর্যন্ত লিখিয়া মনে হইতেছে, কেবলই প্যাচাল পাড়িতেছি। তাই এ লেখার পরিসর না বাড়ানোই উচিত। এ কারণে শামসুল ইসলাম ও এম আর মুকুল এই দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ১৯৯১ পরবর্তী একদিনের আড্ডার কিছু কথা দিয়া এ লেখা শেষ করিতে চাই।
১৯৯১ এর নির্বাচনে অনেকে নিশ্চিত ছিলেন বা ধরিয়া লইয়াছিলেন যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতিবে- যেমন এখন অনেকে নিশ্চিত হইয়া বসিয়া আছেন বিএনপি নির্বাচনে জিতিবে। কিন্তু ১৯৯১ সালে আন্ডারডগ ছিলো বিএনপি, তাহারাই আওয়ামী লীগের সেই আশায় ছাই দিয়া কাপ লইয়া চলিয়া গিয়াছিলো।
ওই সময়ে আওয়ামী লীগ বিশেষ করিয়া তাহাদের নেত্রীকে লইয়া সকলে নানান সমালোচনা করিতেছিলো। তাহাদের ত্রুটিই বেশি সামনে আসিতেছিলো। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে কোন বার্তা ছিলো না। তাহারা যেন অনেকখানি মাটির নিচে চলিয়া গিয়াছিলো।
এই সময়ে শামসুল ইসলাম ভাই একদিন আসিয়া এম আর আখতার মুকুল ভাইকে বলিলেন, “এই মুকুল, তোমার আওয়ামী লীগ এখন কী করছে?”
যে কোন কথার উত্তর এম আর আখতার মুকুলের ঠোঁটেই থাকিত। মুখের ভিতর হইতে বাহির করিয়া আনিবার প্রয়োজন পড়িত না। তিনি তৎক্ষণাৎ বলিলেন, “আওয়ামী লীগ আঁচাচ্ছে।”
শামসুল ইসলাম ভাই আমার দিকে তাকাইলেন, বুঝিলাম উনিও আমার মতো ওই শব্দের অর্থ হয়তো বুঝিতে পারেন নাই।
এম আর আখতার মুকুল চরমপত্র করা মানুষ, চোখের চাহনি দেখিয়া ভাষা বুঝিতে তাহার বিন্দুমাত্র সময় লাগিত না। তিনি আমাকে বলিলেন, “বুঝ আঁচানো মানে কি?” বলিলাম—না।
ইসলাম ভাইও বলিলেন, “আমিও তো বুঝলাম না।”
মুকুল ভাই বলিলেন, “বাঘ কোন কারণে খাদে পড়িয়া যাইবার পরে প্রথমে খাদে বসিয়াই তাহার থাবায় যে কাঁটার আঘাতে ক্ষত হইয়া থাকে তাহা নিজের জিহ্বা, নিজের শরীরের রস দিয়া চাটিয়া চাটিয়া শুকাইতে থাকে। তাহার থাবাকে সুস্থ করিবার জন্যে নিজের জিহ্বা দিয়া ওই থাবা চাটিবার কাজটিকে বলা হয় আঁচানো।”
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

স্বদেশ রায় 


















