সারাক্ষণ রিপোর্ট
দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এক মাসের ব্যবধানে আবারও বড় ধাক্কা দিয়েছে সাধারণ মানুষের সংসারে। ঈদের ছুটি পার হতেই চাল, আলু, দেশি পেঁয়াজ, টমেটো, বেগুন, করলা, সোনালি মুরগি—সবকিছুর দাম এক লাফে বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বাজার করাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
দাম বৃদ্ধির সর্বশেষ চিত্র
রাজধানী ঢাকার পাইকারি ও খুচরা বাজারে মিনিকেট চাল কেজি ৮৫–৯২ টাকায়, মোটা চাল ৬০–৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আলু ৩০–৩৫ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৫৫–৬৫ টাকা, টমেটো ১২০–১৪০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। সবজির দাম ২৫–৪৫ শতাংশ বেশি, সোনালি মুরগি কেজি ২৮০–৩২০ টাকা।
‘এভাবে চললে খাওয়াই কঠিন হবে’
মিরপুরের গৃহিণী শারমিন আক্তার বললেন, “আগে ১,৫০০ টাকায় এক সপ্তাহের সবজি-চাল-ডাল কেনা যেত। এখন দুই হাজার টাকাতেও হচ্ছে না। শিশুদের ভালো করে খাওয়ানো তো দূরের কথা, কাটছাঁট করেই চলতে হচ্ছে।”
বাজারে অস্থিরতার কারণগুলো
বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন—
দেশে পর্যাপ্ত উৎপাদন থাকা সত্ত্বেও সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল।
অসাধু মজুদদারদের সিন্ডিকেট কার্যক্রম।
পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি (জ্বালানির দাম এবং রোড টোলের কারণে)।
সরকারি নজরদারির ঘাটতি।
মৌসুমি কারণে কিছু সবজির সরবরাহ কমে যাওয়া।
বিশ্ব বাজারের প্রভাবও আছে
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর সর্বশেষ ফুড প্রাইস ইনডেক্সে দেখা যাচ্ছে—২০২৪ সালের শেষ ভাগে বিশ্বে চাল ও পেঁয়াজের দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ায় স্থানীয় সিন্ডিকেট, ভোক্তা চাহিদা এবং সীমান্তের অনিয়মিত বাণিজ্য দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে—বাংলাদেশের খাদ্য বাজারের প্রকৃত সমস্যাগুলো হলো “অপর্যাপ্ত গুদাম ব্যবস্থাপনা, স্বল্পমেয়াদী আমদানি নীতির অস্থিরতা এবং স্থানীয় পর্যায়ে বাজার তদারকির দুর্বলতা।”
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মাহফুজুল হক বলেন, “মজুদ নীতির ফাঁকফোকর এবং বাজার মনিটরিং দুর্বল থাকলে কৌশলী ব্যবসায়ীরা তা কাজে লাগায়। চাল-সবজির মতো প্রধান নিত্যপণ্যে যখন দাম ১০–৫০% বেড়ে যায়, তখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।”
তিনি আরও বলেন, “এই দামবৃদ্ধি সরাসরি মূল্যস্ফীতিকে তাতিয়ে তোলে। সরকার বলছে জুন পর্যন্ত বার্ষিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯–১০ শতাংশের মধ্যে, কিন্তু বাস্তবে নিত্যপণ্যে এটি ১২–১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শ
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) তাদের সর্বশেষ আউটলুকে বলেছে—
বাংলাদেশকে বাজার ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনতে হবে।
খাদ্য মজুদ নীতি আধুনিক করতে হবে।
কৃষক পর্যায়ে ন্যায্য দাম এবং ভোক্তা পর্যায়ে সহনীয় দামের মধ্যে সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে হবে।
খোলা বাজারে সরকারের বিক্রয় কার্যক্রম (ওএমএস/টিসিবি) আরও লক্ষ্যভিত্তিক ও নিয়মিত করতে হবে।
সরকারি উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা
টিসিবি খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি করলেও এর আওতা সীমিত। অনেকেই অভিযোগ করছেন, তালিকা, ভিড় এবং অনিয়মের কারণে প্রকৃত দরিদ্র মানুষ এই সুবিধা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে—আমদানি শুল্ক শিথিল রাখা, খোলা বাজারে চাল-আলু-পেঁয়াজ বিক্রি চালু রাখা এবং মজুদদারদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হবে।
তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, নীতিগত সমস্যা থেকে সমাধান না এলে এই পদক্ষেপগুলো টেকসই হবে না।
সমাধান কী?
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ—
নিয়মিত বাজার নজরদারি এবং বড় ব্যবসায়ী-মিল মালিক-হোলসেলারদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ।
খাদ্যপণ্যের আমদানি নীতি সহজ করা এবং রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত কৌশল।
সরকারি গুদাম মজুদ ও বিতরণ ব্যবস্থা আধুনিক করা।
কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমানো।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি (ওএমএস, টিসিবি) সারা বছর লক্ষ্যভিত্তিক রাখা।
যদি এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে এ বছরের বাকি সময়টাতেই নিত্যপণ্যের দামের এই ঊর্ধ্বগতি নতুন করে খাদ্য নিরাপত্তার সংকট তৈরি করবে। সবচেয়ে বেশি ভুগবে দিন আনা–দিন খাওয়া মানুষ এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। তাই শুধু মৌসুমি অভিযান নয়—দীর্ঘমেয়াদী ও নীতিগত সমাধান দরকার এখনই।