হামলার ক্রমপুঙ্খানুসার বিবরণ
২০১৬ সালের ১ জুলাই, রাত ৯টা ৪০-এর দিকে গুলশানের অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারিতে পাঁচ সশস্ত্র জঙ্গি ঢুকে বিদেশি ও দেশি অতিথিদের জিম্মি করে। হামলায় ২০ জন জিম্মি (১৭ বিদেশি ও ৩ বাংলাদেশি), দুই পুলিশ কর্মকর্তা, দুজন স্টাফ এবং পাঁচ জঙ্গিসহ মোট ২৯ জনের মৃত্যু হয়; আহত হন অর্ধশতাধিক, অধিকাংশই পুলিশ সদস্য।
‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ ও উদ্ধার অভিযান
রাতভর ব্যর্থ আলোচনার পর ২ জুলাই ভোর ৭টা ৪০-এ সেনাবাহিনীর ১ম প্যারা-কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ চালিয়ে ১৩ জন জিম্মিকে উদ্ধার করে এবং পাঁচ জঙ্গিকে হত্যা করে। অপারেশনটি মাত্র ৫০ মিনিট স্থায়ী হলেও দেশ-বিদেশে এর প্রভাব ছিল ব্যাপক।
আইনগত অগ্রগতি: রায় ও আপিল
২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল ‘নিও-জেএমবি’ সংশ্লিষ্ট সাত আসামির মৃত্যুদণ্ড দেন।
কিন্তু ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ডগুলো কমিয়ে ‘সাজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যাবজ্জীবন’ কারাদণ্ডে রূপান্তর করে, রায়ে ষড়যন্ত্র ও সহায়তার দায় প্রমাণিত হলেও সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকার যুক্তি দেখায়।
২০২৫ সালের ১৮ জুন প্রকাশিত ২২৯-পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত পুনরায় সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়েছে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকম্প
হামলার পর তৎকালীন সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করে এবং মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সারা দেশে ১১,০০০-এর বেশি মানুষকে আটক করে, যদিও সিংহভাগই মামলাহীন বা অপ্রীতিকর রাজনৈতিক গ্রেপ্তার বলে সমালোচিত হয়।
২০১৭ সালে বিশেষায়িত ‘Anti-Terrorism Unit (ATU)’ গঠন করা হয়, যাতে প্রযুক্তিনির্ভর গোয়েন্দা কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
কেন উচ্চশিক্ষিত তরুণরা এগিয়ে এল?
জঙ্গিরা উচ্চবিত্ত পরিবার ও ইংরেজি মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় বাংলাদেশে ফার্স্ট-জেনারেশন কথিত এলিট মৌলবাদ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। রক্ষণশীল ধর্মীয় বয়ান, অনলাইনে আইএস-এর প্রোপাগান্ডা আর বিশ্বরাজনীতির আঘাত-প্রতিঘাত—সব মিলিয়ে তরুণদের পরিচয় সংকটকে জঙ্গিরা পুঁজি করে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সুপারিশ করার ফলে কয়েকটি ধনী পরিবারের সন্তানকে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করতে রাজনৈতিকভাবে বাধা দেওয়ার ফলে অনেক সত্য নাজানা থাকে। সব মিলে সংকটকে যারা পুঁজি করতে চেয়েছিল তারা আরও বেশি সুবিধা পায়।
ডিজিটাল জিহাদ: সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন ফ্রন্ট
বিআইপিএসএস-এর ২০১৭-এর জরিপ বলছে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো তরুণদের ‘টার্গেটেড রিক্রুটমেন্ট’-এ সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। স্মার্টফোনের প্রসার, সস্তা ডেটা ও এনক্রিপটেড অ্যাপের মাধ্যমে ধর্মীয় চেতনা সহজেই চরমপন্থায় মোড় নেয়।
মৌলবাদী মানসিকতার বিস্তার—গবেষণার দৃষ্টিতে
যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অফ পিসের ২০২২-এর বিশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬-এর পর সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা কমলেও ইসলামী চরমপন্থী সংগঠনগুলো নিয়মিত নতুন সদস্য নিয়োগ ও বিচ্ছিন্ন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে; রাষ্ট্র ও সমাজে ‘ধর্ম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা’ দ্বন্দ্ব গভীরতর হয়েছে।
রাষ্ট্রের জিরো টলারেন্স নীতি ও মিশ্র ফলাফল
আইনি ব্যবস্থার কঠোরতা মৌলবাদী নেটওয়ার্ক দুর্বল করলেও ভিন্নমত দমনের অভিযোগে সামাজিক আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, কেবল নিরাপত্তা-কেন্দ্রিক পন্থা নয়—মানবাধিকারভিত্তিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক সমাধানই দীর্ঘমেয়াদে মৌলবাদী মানসিকতা ঠেকাতে পারে।
সামনে পথচলা: করণীয়
• দক্ষ ও সমালোচনামূলক চিন্তাশীল শিক্ষা-পদ্ধতি নিশ্চিত করা
• মসজিদ-মাদরাসা-স্কুলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঠ
• অনলাইন কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ ও বিকল্প ইতিবাচক বয়ান তৈরি
• নিহতদের স্মৃতিকে সম্মান দিয়ে বার্ষিক ‘শান্তি সংলাপ’ আয়োজন
• আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে মানবাধিকার প্রশিক্ষণ
নয় বছর আগে গুলশানের ওই রাত শুধু এক বেদনায় নয়, দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়েছিল। হামলার স্মৃতি আজ যদি তরুণ-সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলে—কীভাবে ভিন্ন মত, ধর্ম ও সংস্কৃতির সহাবস্থানে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে প্রতিহত করা যায়? তাহলে এই প্রশ্নের উত্তরেই বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের ভাবমূর্তি নির্ধারিত হবে।