অষ্টম পরিচ্ছেদ
কাঁধে আবার রাইফেলটা ঝুলিয়ে নিতে-নিতে চুবুক কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনে কে?’
‘আমি কি আগে জিজ্ঞেসা করতে পারি, তোমরা কে?’ বৃদ্ধ আগের মতোই শান্ত, নিরুত্তাপ গলায় পালটা প্রশ্ন করল। ‘যদি তোমরা এ বাড়িতে আসা দরকারই বোধ করে থাক, তাহলে দয়া করে বাড়ির কত্তার কাছে তোমাদের পরিচয় দেবে কী? অবিশ্যি, অনুমান করা শক্ত নয়, চুবুকের সর্বাঙ্গে মলিন কটা চোখ দুটো বুলিয়ে নিয়ে বুড়ো ফের বলল, ‘তোমরা লাল, তাই না?’
লোকটির নিচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়ল, যেন কেউ টেনে ঠোঁটটা নিচে নামিয়ে দিল। একটা সোনার দাঁত ঝলসে উঠেই হলদে আভা ছড়িয়ে ফের মিইয়ে গেল, আর হঠাৎ সজাগ হয়ে-ওঠা চোখের পাতা দুটো লোকটির কটা চোখ থেকে যেন গুলো ঝেড়ে ফেলে দিল। অতিথিপরায়ণ গৃহকর্তার মতো আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে হাত দুলিয়ে বৃদ্ধ আমাদের তার সঙ্গে যেতে বলল:
‘আন্তাজ্ঞে হোক, ভদ্রমহোদয়গণ।’
পরস্পরের দিকে থতমত খেয়ে তাকালুম আমরা। তারপর বিধ্বস্ত ঘরখানার মধ্যে দিয়ে হে’টে গিয়ে সরু একটা কাঠের সিড়ি ধরলুম।
‘অতিথিদের এখন আমি দোতলায় বসাই কিনা’, আমাদের গৃহকর্তা ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল। ‘একতলাটা এত নোংরা হয়ে আছে। সাফ করার লোকও নেই, সবাই সরে পড়েছে। এইদিকে এস।’
ছোট্ট কিন্তু আলোহাওয়া যুক্ত একটা ঘরে এসে হাজির হলুম আমরা। ঘরটায় দেয়ালের গায়ে দাঁড় করানো ছিল ছোঁড়াখোঁড়া, ছোবড়া-বের-করা, পুরনো ভাঙাচোরা একটা সোফা। চাদরের ঢাকনার বদলে সোফাটা গাছের বাকলে-তৈরি মাদুর দিয়ে ঢাকা ছিল। আর, এককালে দেখতে সুন্দর ছিল কিন্তু এখন বড়-বড় পোড়া গর্তে ভরতি এমন একখানা গালচে দিয়ে সোফার ওপর কম্বলের কাজ চালানো হচ্ছিল। সোফার পাশেই দাঁড় করানো ছিল তেপায়া একটা লেখার টেবিল। টেবিলটার ওপর ক্যানারি পাখি-সমেত একখানা খাঁচা ঝুলছিল।
ক্যানারি পাখিটা ছিল আবার মরা। পাখিটা যে অনেক কাল আগেই মরে গিয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। দানার পাত্রের মধ্যে ঠ্যাং দুটো ওপর-দিকে-করে মরে পড়ে ছিল পাখিটা। ঘরের দেয়ালে টাঙানো ছিল কয়েকখানা ধূলোয়-ঢাকা ফোটোগ্রাফ। বোঝা যাচ্ছিল, বাড়ির ভাঙাচোরা আসবাবপত্রের মধ্যে যে ক-খানা অবশিষ্ট ছিল সেগুলোকে ওই ঘরে বৃদ্ধের ব্যবহারের জন্যে টেনে আনতে অপর কেউ গৃহকর্তাকে সাহায্য করেছিল।