০৬:৩৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
শিশুদের অ-সংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের নতুন সেবা মডেল নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধি থামছেই না: গরিবের হাঁড়িতে সঙ্কট আবু সাঈদকে নিয়ে ফেসবুক কটুক্তির জেরে স্কুল ছাত্র গ্রেফতার, তিনদিন পর জামিন বরগুনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ ঢাকায় ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা, সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর  সংকেত জুলাই হলি আর্টিজান হামলা: বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মে মৌলবাদী মানসিকতার বীজ আন্তর্জাতিক বই আমদানিতে শুল্কারোপ: জ্ঞানের দরজায় দেয়াল, খুলছে কি? গার্মেন্টস শিল্পে নারী শ্রমিক কমে যাচ্ছে একশ বছরের গাথা: মাতামুহুরী নদীর উত্থান-পতন জুলাইয়ে সম্ভাব্য বন্যা: কোন এলাকায় বেশি ঝুঁকি

কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়াদের জন্যেই নতুন করে চালু হচ্ছে কোটা?

কোটাবিরোধী আন্দোলনে আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনের জন্যে নেয়া পদক্ষেপ নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক

গত বছর জুলাই আন্দোলনের সময় ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে আহত হন আরিয়ান আহমেদ। সরকারি গেজেটে ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত আহত হিসেবে উঠেছে তার নাম।

সেই হিসেবে, এককালীন এক লাখ এবং মাসিক ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন তিনি।

একইভাবে জুলাইয়ে অংশ নেয়া ‘ক’ ও ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত আহত এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যদের ক্যাটাগরি অনুযায়ী মাসিক ও এককালীন ভাতা দেয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তার মধ্যে রয়েছে সরকারি হাসপাতালে আহতদের আজীবন বিনা খরচে চিকিৎসা সুবিধা, সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে আহত ও নিহতদের পরিবারের সক্ষম সদস্যদের অগ্রাধিকারের মতো বিশেষ সুবিধা।

ফলে পুনর্বাসনের জন্যে সরকারের নেয়া এসব উদ্যোগ নিয়ে দেখা গেছে নানা ধরনের বিতর্ক।

বিশেষ করে, কোটা বিলোপের যে আন্দোলন থেকে সবকিছুর সূত্রপাত সেখান থেকেই নতুন করে কোটা চালু হচ্ছে কিনা, উঠছে এমন প্রশ্নও।

একদিকে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয়া কিংবা নেতৃত্ব পর্যায়ে থাকা অনেকেই যেমন ঢালাওভাবে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তেমনি আবার পুনর্বাসনের জন্যে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে আন্দোলন হলেও গুটিকয়েক মানুষকে আলাদাভাবে এসব সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মতো’ নতুন করে সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হবার শঙ্কা আছে। একইসাথে হতে পারে জুলাইয়ের রাজণীতিকরণও।

পুনর্বাসনের জন্য নেয়া হয়েছে যেসব পদক্ষেপ

২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে প্রায় ২০ দিনের আন্দোলনে নিহত ৮৩৪ জনের এবং তিন ক্যাটাগরিতে আহত ১২ হাজার ৪৩ জনের তালিকা তৈরি করেছে সরকার।

এদের মধ্যে ‘অতি গুরুতর আহত’দের ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে, যার মোট সংখ্যা ৪৯৩ জন। এছাড়া ৯০৮ জন ‘গুরুতর আহত’কে ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত এবং ১০ হাজার ৬৪২ জনকে ‘আহত’কে ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।

‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এ আন্দোলনে নিহতদের ‘জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ’ এবং আহতদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে।

এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের পরিচয়পত্র দেয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এগুলোর মধ্যে আছে,

  • নিহতদের পরিবার ও আহতদের এককালীন ও মাসিক ভাতা দেয়ার উদ্যোগ
  • সরকারি হাসপাতালে আহতদের আজীবন বিনা খরচে চিকিৎসা সুবিধা
  • সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে আহত ও নিহতদের পরিবারের সক্ষম সদস্যদের অগ্রাধিকার
  • যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের জন্যে সহজ শর্তে ঋণ বা অনুরূপ সুবিধা দেয়া

জুলাইয়ে আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের দেয়া হয়েছে বাড়তি করছাড়

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে জুলাইয়ে নিহতদের পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের জন্য ৪০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ২৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের জন্যে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা এককালীন ভাতা এবং ২০ হাজার টাকা করে মাসিক ভাতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

আর ‘ক’, ‘খ’ এবং ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত আহতরা যথাক্রমে এককালীন পাঁচ লাখ, তিন লাখ এবং এক লাখ টাকা আর মাসিক ২০ হাজার, ১৫ হাজার এবং ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন।

আবার কর দেওয়ার সময় একজন সাধারণ মানুষকে যেখানে তার আয়ের ওপর ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত করছাড় দেয়া হয়েছে, সেখানে আন্দোলনে আহতদের জন্যে এই সীমা দেয়া হয়েছে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

এছাড়াও আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং গুরুতর আহতদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার খবরও এসেছে গণমাধ্যমে।

এর আগে, গত ফেব্রুয়ারিতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বরাদ্দ ৫ শতাংশ কোটার সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের পরিবারের সদস্যদের যুক্ত করে এক আদেশ জারি করা হয়।

পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেই আদেশ বাতিল করে কেবল ২০২৫ সালের জন্য নতুন নির্দেশনা দেয়া হয়।

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম

‘জুলাই কোটা’ বিতর্ক নিয়ে যা বলছেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা

আহতদের তালিকায় নাম ওঠা আরিয়ান আহমেদের মতে, নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং আহতদের জন্যে চিকিৎসা সুবিধা দেয়া উচিৎ। তবে চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের বিষয়টি নিয়ে আলাপের জায়গা আছে।

“কোটা কি আবার ফিরে আসলো নাকি” এমন প্রশ্ন তুলে খোদ সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছেন বলেও বিবিসি বাংলাকে জানান তিনি।

“আমার মনে হয় যোগ্যতার ওপর নির্ভর করেই চাকরি দেয়া উচিৎ। কোটা সিস্টেম চালু হচ্ছে বা বলছে, এটা টোটালি বন্ধ রাখা উচিৎ। যে কোটার জন্যে এত যুদ্ধ করলাম সেটা যেন আবার চালু না হয়”, বলছিলেন মি. আহমেদ।

ঢালাওভাবে তালিকার সবাইকে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আরেক আন্দোলনকারী সীমা আক্তারও। জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী।

তার মতে, আন্দোলনে নিহত ও আহতদের সবার অর্থনৈতিক অবস্থা সমান না। সেক্ষেত্রে ভাতা দেয়ার বিষয়টি ঠিক থাকলেও চাকরির ক্ষেত্রে কোটা, করছাড় কিংবা ফ্ল্যাট দেয়ার সিদ্ধান্ত পুনির্বিবেচনার সুযোগ আছে।

“যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের একটা পুনর্বাসন দরকার। এই শহীদদের পুনর্বাসন এবং আহতদের সুচিকিৎসা এখন পর্যন্ত সুনিশ্চিত হয় নাই। আপনারা দেখেছেন আহত লীগ, সিন্ডিকেট- অনেকেই আহত না হয়ে আহতের লিস্টে চলে আসছে। কোটার মতো একটা বিষয় চলে আসতে পারে, এটাই আমার ভয়”, বলছিলেন সীমা আক্তার।

জুলাই আন্দোলনে ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত আহত আরিয়ান আহমেদ

মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু, সেই আন্দোলনেরই আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনের জন্যে নেয়া উদ্যোগই নতুন করে কোটার চালু করবে কিনা, এমন বিতর্ক ‘সঠিক নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

“আমরা তো ৫০ বছর পর আপনি যখন নাতি-পুতিদেরও কোটা দিচ্ছেন ৩০ পার্সেন্ট, যেখানে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও প্রবেশ করছে, তখন আমরা এই কোটার বিরুদ্ধে বলেছি যে এটা বৈষম্যমূলক। ফলে এটার (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) সাথে তো এটার (জুলাই) তুলনা না। তুলনা হতো যদি তাদের সন্তান, কয়েক প্রজন্ম এটা পায় বা তাদের সেই কমিটমেন্ট দেয়া হয়”।

“(জুলাই আন্দোলনে) যে অন্ধ হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, যার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ মারা গেছে, সেই পরিবারটা কীভাবে চলবে? তার আর্থিক নিরাপত্তাটা কী? এটাতো রাষ্ট্রকে দেখতে হবে, এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। ফলে এটা আমি কোটা সিস্টেম হিসেবে দেখি না”, বলছিলেন তিনি।

একই বিষয়কে আবার কিছুটা ভিন্নভাবে দেখছেন কোটাবিরোধী আন্দোলনের আরেক পরিচিত মুখ উমামা ফাতেমা। আন্দোলনের পর থেকেই নিহতদের পরিবার ও আহতদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি।

“আমরা যদি সক্ষমতা বৃদ্ধির জায়গা থেকে দেখি, সরকার কিন্তু ওইরকম উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেয়নি। সরকার খুবই সার্ফেস লেভেলে বিষয়টাকে ডিল করার চেষ্টা করে। এভাবে সার্ফেস লেভেলে ডিল করার চেষ্টা করলেতো আপনি একচুয়ালি সাধারণ জনগণের থেকে শহীদ পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন”।

“পুনর্বাসন করাটা অত্যন্ত জরুরি – কিন্তু কোন পদ্ধতিতে সরকার করছে, এটা অবশ্যই ভাববার বিষয়”, বলছিলেন মিজ ফাতেমা।

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা

‘তৈরি হতে পারে পুনর্বাসন সুবিধার অপব্যবহারের সুযোগ’

জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহতদের তালিকা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাদের দেয়া হয়েছে আলাদা পরিচয়পত্রও। কিন্তু এরইমধ্যে ‘ভুয়া জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে সেসব সুযোগ-সুবিধা নেয়া কিংবা আহতদের হাসপাতাল দখলের খবর এসেছে গণমাধ্যমে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যথাযথভাবে পুনর্বাসন না করে ঢালাওভাবে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলে তা মুক্তিযোদ্ধা কোটার মতোই অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।

“৭১’এ ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে, তাদের স্বজনদের জন্যে আমরা কী করেছি? ৫০ বছর ধরে নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অনেকেই নিহত হয়েছে, তাদের পরিবারের কোনো খোঁজ আছে? যারা অতীত ভুলে শুধু জুলাই নিয়ে পড়ে আছেন তারা বাড়াবাড়ি করছেন”, বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।

তার মতে, বিরাট একটি জনগোষ্ঠী এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। সেখান থেকে গুটিকয়েক ব্যক্তিকে বেতন, ভাতা আর চাকরি দিয়ে আবার একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি করা হচ্ছে।

“এই টাকাগুলো কিন্তু যারা এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তারা তাদের পকেট থেকে দেবে না। এটা জনগণের টাকা, গরীব মানুষের ট্যাক্সের টাকা। সুতরাং এই বিষয়গুলোতো বিবেচনা করা দরকার”, বলেন তিনি।

“সরকারের দায়িত্বতো সব নাগরিকের ওপর। গুটিকয়েক লোকের জন্যে তো না। কিন্তু আবার কোটার ভিত্তিতে চাকরি দেয়া, ভাতা দেয়া – এটারতো কোনো মানে হয় না। এটাতো সেই আগের পথেই ফিরে যাওয়া”, বলেন এই বিশ্লেষক।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম

বিতর্ক নিয়ে যা বলছে সরকার

জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং আহতদের জন্যে এককালীন অর্থ, মাসিক সম্মানী, চিকিৎসা ভাতা, বাসস্থানের ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের করতে সরকার এখন পর্যন্ত ৬৩৫ কোটিরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।

এই ধরনের পদক্ষেপ কি ভবিষ্যতে নতুন কোনো কোটা বা বৈষম্যে রূপ নিতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “না। এটার (জুলাই আন্দোলনে আহত ও নিহত) সংখ্যা তো খুবই কম। এটা এবজর্ব হয়ে যাবে”।

“এটা কোটা নিয়ে লিঙ্গারিংয়ের কোনো বিষয় না, এটার বিষয়টা শহীদ আর আহত পর্যন্ত। এরপর আর এটা যাবে না। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এমনকি গত সরকার এটাকে নাতিপুতি পর্যন্ত নিয়ে গেছে, যেটা চ্যালেঞ্জ এসেছে মানুষের কাছ থেকে, সমাজের কাছ থেকে। এটা সেরকম নয়”, বলেন তিনি।

বিবিসি নিউজ বাংলা

শিশুদের অ-সংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের নতুন সেবা মডেল

কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়াদের জন্যেই নতুন করে চালু হচ্ছে কোটা?

০৩:০৪:৩৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

গত বছর জুলাই আন্দোলনের সময় ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে আহত হন আরিয়ান আহমেদ। সরকারি গেজেটে ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত আহত হিসেবে উঠেছে তার নাম।

সেই হিসেবে, এককালীন এক লাখ এবং মাসিক ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন তিনি।

একইভাবে জুলাইয়ে অংশ নেয়া ‘ক’ ও ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত আহত এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যদের ক্যাটাগরি অনুযায়ী মাসিক ও এককালীন ভাতা দেয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তার মধ্যে রয়েছে সরকারি হাসপাতালে আহতদের আজীবন বিনা খরচে চিকিৎসা সুবিধা, সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে আহত ও নিহতদের পরিবারের সক্ষম সদস্যদের অগ্রাধিকারের মতো বিশেষ সুবিধা।

ফলে পুনর্বাসনের জন্যে সরকারের নেয়া এসব উদ্যোগ নিয়ে দেখা গেছে নানা ধরনের বিতর্ক।

বিশেষ করে, কোটা বিলোপের যে আন্দোলন থেকে সবকিছুর সূত্রপাত সেখান থেকেই নতুন করে কোটা চালু হচ্ছে কিনা, উঠছে এমন প্রশ্নও।

একদিকে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয়া কিংবা নেতৃত্ব পর্যায়ে থাকা অনেকেই যেমন ঢালাওভাবে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তেমনি আবার পুনর্বাসনের জন্যে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণে আন্দোলন হলেও গুটিকয়েক মানুষকে আলাদাভাবে এসব সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মতো’ নতুন করে সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হবার শঙ্কা আছে। একইসাথে হতে পারে জুলাইয়ের রাজণীতিকরণও।

পুনর্বাসনের জন্য নেয়া হয়েছে যেসব পদক্ষেপ

২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে প্রায় ২০ দিনের আন্দোলনে নিহত ৮৩৪ জনের এবং তিন ক্যাটাগরিতে আহত ১২ হাজার ৪৩ জনের তালিকা তৈরি করেছে সরকার।

এদের মধ্যে ‘অতি গুরুতর আহত’দের ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে, যার মোট সংখ্যা ৪৯৩ জন। এছাড়া ৯০৮ জন ‘গুরুতর আহত’কে ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত এবং ১০ হাজার ৬৪২ জনকে ‘আহত’কে ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।

‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ পরিবার এবং জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এ আন্দোলনে নিহতদের ‘জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ’ এবং আহতদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে।

এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের পরিচয়পত্র দেয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এগুলোর মধ্যে আছে,

  • নিহতদের পরিবার ও আহতদের এককালীন ও মাসিক ভাতা দেয়ার উদ্যোগ
  • সরকারি হাসপাতালে আহতদের আজীবন বিনা খরচে চিকিৎসা সুবিধা
  • সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে আহত ও নিহতদের পরিবারের সক্ষম সদস্যদের অগ্রাধিকার
  • যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের জন্যে সহজ শর্তে ঋণ বা অনুরূপ সুবিধা দেয়া

জুলাইয়ে আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের দেয়া হয়েছে বাড়তি করছাড়

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে জুলাইয়ে নিহতদের পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের জন্য ৪০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে এই বরাদ্দ ছিল ২৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের জন্যে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা এককালীন ভাতা এবং ২০ হাজার টাকা করে মাসিক ভাতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

আর ‘ক’, ‘খ’ এবং ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত আহতরা যথাক্রমে এককালীন পাঁচ লাখ, তিন লাখ এবং এক লাখ টাকা আর মাসিক ২০ হাজার, ১৫ হাজার এবং ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন।

আবার কর দেওয়ার সময় একজন সাধারণ মানুষকে যেখানে তার আয়ের ওপর ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত করছাড় দেয়া হয়েছে, সেখানে আন্দোলনে আহতদের জন্যে এই সীমা দেয়া হয়েছে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

এছাড়াও আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং গুরুতর আহতদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার খবরও এসেছে গণমাধ্যমে।

এর আগে, গত ফেব্রুয়ারিতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বরাদ্দ ৫ শতাংশ কোটার সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের পরিবারের সদস্যদের যুক্ত করে এক আদেশ জারি করা হয়।

পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেই আদেশ বাতিল করে কেবল ২০২৫ সালের জন্য নতুন নির্দেশনা দেয়া হয়।

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম

‘জুলাই কোটা’ বিতর্ক নিয়ে যা বলছেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা

আহতদের তালিকায় নাম ওঠা আরিয়ান আহমেদের মতে, নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং আহতদের জন্যে চিকিৎসা সুবিধা দেয়া উচিৎ। তবে চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের বিষয়টি নিয়ে আলাপের জায়গা আছে।

“কোটা কি আবার ফিরে আসলো নাকি” এমন প্রশ্ন তুলে খোদ সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছেন বলেও বিবিসি বাংলাকে জানান তিনি।

“আমার মনে হয় যোগ্যতার ওপর নির্ভর করেই চাকরি দেয়া উচিৎ। কোটা সিস্টেম চালু হচ্ছে বা বলছে, এটা টোটালি বন্ধ রাখা উচিৎ। যে কোটার জন্যে এত যুদ্ধ করলাম সেটা যেন আবার চালু না হয়”, বলছিলেন মি. আহমেদ।

ঢালাওভাবে তালিকার সবাইকে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আরেক আন্দোলনকারী সীমা আক্তারও। জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী।

তার মতে, আন্দোলনে নিহত ও আহতদের সবার অর্থনৈতিক অবস্থা সমান না। সেক্ষেত্রে ভাতা দেয়ার বিষয়টি ঠিক থাকলেও চাকরির ক্ষেত্রে কোটা, করছাড় কিংবা ফ্ল্যাট দেয়ার সিদ্ধান্ত পুনির্বিবেচনার সুযোগ আছে।

“যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের একটা পুনর্বাসন দরকার। এই শহীদদের পুনর্বাসন এবং আহতদের সুচিকিৎসা এখন পর্যন্ত সুনিশ্চিত হয় নাই। আপনারা দেখেছেন আহত লীগ, সিন্ডিকেট- অনেকেই আহত না হয়ে আহতের লিস্টে চলে আসছে। কোটার মতো একটা বিষয় চলে আসতে পারে, এটাই আমার ভয়”, বলছিলেন সীমা আক্তার।

জুলাই আন্দোলনে ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত আহত আরিয়ান আহমেদ

মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু, সেই আন্দোলনেরই আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনের জন্যে নেয়া উদ্যোগই নতুন করে কোটার চালু করবে কিনা, এমন বিতর্ক ‘সঠিক নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

“আমরা তো ৫০ বছর পর আপনি যখন নাতি-পুতিদেরও কোটা দিচ্ছেন ৩০ পার্সেন্ট, যেখানে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও প্রবেশ করছে, তখন আমরা এই কোটার বিরুদ্ধে বলেছি যে এটা বৈষম্যমূলক। ফলে এটার (মুক্তিযোদ্ধা কোটা) সাথে তো এটার (জুলাই) তুলনা না। তুলনা হতো যদি তাদের সন্তান, কয়েক প্রজন্ম এটা পায় বা তাদের সেই কমিটমেন্ট দেয়া হয়”।

“(জুলাই আন্দোলনে) যে অন্ধ হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, যার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ মারা গেছে, সেই পরিবারটা কীভাবে চলবে? তার আর্থিক নিরাপত্তাটা কী? এটাতো রাষ্ট্রকে দেখতে হবে, এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। ফলে এটা আমি কোটা সিস্টেম হিসেবে দেখি না”, বলছিলেন তিনি।

একই বিষয়কে আবার কিছুটা ভিন্নভাবে দেখছেন কোটাবিরোধী আন্দোলনের আরেক পরিচিত মুখ উমামা ফাতেমা। আন্দোলনের পর থেকেই নিহতদের পরিবার ও আহতদের নিয়ে কাজ করছেন তিনি।

“আমরা যদি সক্ষমতা বৃদ্ধির জায়গা থেকে দেখি, সরকার কিন্তু ওইরকম উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেয়নি। সরকার খুবই সার্ফেস লেভেলে বিষয়টাকে ডিল করার চেষ্টা করে। এভাবে সার্ফেস লেভেলে ডিল করার চেষ্টা করলেতো আপনি একচুয়ালি সাধারণ জনগণের থেকে শহীদ পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন”।

“পুনর্বাসন করাটা অত্যন্ত জরুরি – কিন্তু কোন পদ্ধতিতে সরকার করছে, এটা অবশ্যই ভাববার বিষয়”, বলছিলেন মিজ ফাতেমা।

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা

‘তৈরি হতে পারে পুনর্বাসন সুবিধার অপব্যবহারের সুযোগ’

জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহতদের তালিকা করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাদের দেয়া হয়েছে আলাদা পরিচয়পত্রও। কিন্তু এরইমধ্যে ‘ভুয়া জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে সেসব সুযোগ-সুবিধা নেয়া কিংবা আহতদের হাসপাতাল দখলের খবর এসেছে গণমাধ্যমে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যথাযথভাবে পুনর্বাসন না করে ঢালাওভাবে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলে তা মুক্তিযোদ্ধা কোটার মতোই অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।

“৭১’এ ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে, তাদের স্বজনদের জন্যে আমরা কী করেছি? ৫০ বছর ধরে নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অনেকেই নিহত হয়েছে, তাদের পরিবারের কোনো খোঁজ আছে? যারা অতীত ভুলে শুধু জুলাই নিয়ে পড়ে আছেন তারা বাড়াবাড়ি করছেন”, বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।

তার মতে, বিরাট একটি জনগোষ্ঠী এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। সেখান থেকে গুটিকয়েক ব্যক্তিকে বেতন, ভাতা আর চাকরি দিয়ে আবার একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি করা হচ্ছে।

“এই টাকাগুলো কিন্তু যারা এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তারা তাদের পকেট থেকে দেবে না। এটা জনগণের টাকা, গরীব মানুষের ট্যাক্সের টাকা। সুতরাং এই বিষয়গুলোতো বিবেচনা করা দরকার”, বলেন তিনি।

“সরকারের দায়িত্বতো সব নাগরিকের ওপর। গুটিকয়েক লোকের জন্যে তো না। কিন্তু আবার কোটার ভিত্তিতে চাকরি দেয়া, ভাতা দেয়া – এটারতো কোনো মানে হয় না। এটাতো সেই আগের পথেই ফিরে যাওয়া”, বলেন এই বিশ্লেষক।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম

বিতর্ক নিয়ে যা বলছে সরকার

জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং আহতদের জন্যে এককালীন অর্থ, মাসিক সম্মানী, চিকিৎসা ভাতা, বাসস্থানের ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের করতে সরকার এখন পর্যন্ত ৬৩৫ কোটিরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।

এই ধরনের পদক্ষেপ কি ভবিষ্যতে নতুন কোনো কোটা বা বৈষম্যে রূপ নিতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “না। এটার (জুলাই আন্দোলনে আহত ও নিহত) সংখ্যা তো খুবই কম। এটা এবজর্ব হয়ে যাবে”।

“এটা কোটা নিয়ে লিঙ্গারিংয়ের কোনো বিষয় না, এটার বিষয়টা শহীদ আর আহত পর্যন্ত। এরপর আর এটা যাবে না। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এমনকি গত সরকার এটাকে নাতিপুতি পর্যন্ত নিয়ে গেছে, যেটা চ্যালেঞ্জ এসেছে মানুষের কাছ থেকে, সমাজের কাছ থেকে। এটা সেরকম নয়”, বলেন তিনি।

বিবিসি নিউজ বাংলা