ভাইরাল লাটে থেকে বাস্তব সংকট
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সূক্ষ্ম গুঁড়ো সবুজ চা বা ম্যাচা শুধু পানীয় নয়, হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ এক জীবনধারার প্রতীক। ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকে নানারকম ম্যাচা লাটে, কেক, আইসক্রিম আর বোলের রিল দিনের পর দিন ভাইরাল হয়েছে; বাড়ি হোক বা ক্যাফে—সব জায়গায়ই যেন সবুজ ফেনায় চা ওঠার প্রতিযোগিতা। কিন্তু এই জনপ্রিয়তার পেছনে যে কৃষি ও সরবরাহব্যবস্থা কাজ করে, সেখানে এখন চাপ বেড়েছে মারাত্মকভাবে। জাপানের ঐতিহ্যবাহী চা-বাগানগুলো মানসম্মত ম্যাচার বাড়তি চাহিদা মেটাতে গিয়ে কখনও জলবায়ু পরিবর্তন, কখনও শ্রমিকসংকট, কখনও আবার বাড়তি খরচের দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে।
উচ্চমানের ম্যাচা তৈরি করতে চা গাছকে কয়েক সপ্তাহ ছায়ায় রাখা, হাতে পাতা তোলা এবং পাথরে গুঁড়ো করার মতো সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া লাগে। বহুজাতিক কফি চেইন আর অনলাইন অর্ডারের চাপ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় অনেক সরবরাহকারী বাধ্য হচ্ছে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের পাতা ব্যবহার করতে বা বিভিন্ন অঞ্চলের চা একসঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করতে। মিষ্টি-ক্রিম-সিরাপ মেশানো বড় কাপের পানীয়তে এই তারতম্য বোঝা কঠিন হলেও, চা-রসিকরা বলছেন—সূক্ষ্ম মিষ্টি স্বাদ ও ভারসাম্যপূর্ণ তিতকুটে ভাব ক্রমেই বিরল হয়ে যাচ্ছে। জাপানের কিছু অঞ্চলে আবার নতুন প্ল্যান্টেশন করতে গিয়ে জমি ব্যবহার, পানি সংকট এবং তরুণ শ্রমিক খুঁজে পাওয়া—সব মিলিয়ে নতুন ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে।
ওয়েলনেস মার্কেটিংয়ের বদৌলতে অনলাইনে ম্যাচার ভাবমূর্তি এখনো প্রায় নিখুঁত। “কফির চেয়ে শান্ত ফোকাস”, “ত্বক ঝলমলে হবে”, “ওজন কমবে”—এমন অগণিত দাবি ছড়িয়ে পড়েছে শর্ট ভিডিও আর ইনফ্লুয়েন্সার পোস্টে। ফলাফল হিসেবে অনেক তরুণ প্রতিদিনের রুটিনেই যোগ করেছে দামী ম্যাচা, কাঠের হুইস্ক, বিশেষ বাটি আর সাজানো ব্যাকগ্রাউন্ড; ভিডিও বানানোর সুবিধার জন্য অনেকে অতিরঞ্জিত রঙ ও টপিং যোগ করছে। পুষ্টিবিদরা তবে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অধিকাংশ ভাইরাল রেসিপিতে এত বেশি চিনি ও ক্রিম থাকে যে ঐতিহ্যবাহী সরল এক কাপ চা থেকে সেগুলো অনেক বেশি ক্যালোরিযুক্ত ডেজার্টে পরিণত হয়েছে।

জাপানের উৎপাদকদের একাংশ নতুন এই জনপ্রিয়তাকে সুযোগ হিসেবে দেখলেও উদ্বেগও কম নয়। তাদের মতে, অনেক বিদেশি ক্রেতা কেবল “ইনস্টাগ্রামযোগ্য” উজ্জ্বল রং খুঁজছেন, কিন্তু শেডিং, ফসল তোলা, গুঁড়ো করার মতো শ্রমঘন ধাপের বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। মান বজায় রাখতে হলে দক্ষ শ্রমিক, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং পরিবেশ-সহনশীল চাষাবাদ—সব কিছুর জন্যই বিনিয়োগ দরকার, যা ধ্রুব সরবরাহ ও কম দামের দাবির সঙ্গে মেলানো কঠিন। কিছু ব্র্যান্ড এখন গ্রেড, উৎস ও মৌসুম সম্পর্কে বেশি তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে ভোক্তাকে সচেতন করার চেষ্টা করছে।
সাধারণ ভোক্তাদের জন্য এর মানে হতে পারে কিছুটা অভ্যস্ততার পরিবর্তন। ক্যাফেগুলো হয়তো ভবিষ্যতে অসংখ্য ফ্লেভার ও টপিংয়ের পরিবর্তে সীমিত কিন্তু নির্বাচিত ম্যাচা আইটেম রাখবে, কিংবা দাম কিছুটা বাড়াতে বাধ্য হবে। দীর্ঘমেয়াদে সংকট তীব্র হলে বিকল্প সবুজ উপকরণ—স্পিরুলিনা বা পালং শাকভিত্তিক মিশ্রণ—কৃত্রিমভাবে ম্যাচার মতো রূপ নিয়ে মেন্যুতে জায়গা পেতে পারে। ম্যাচার গল্প দেখিয়ে দেয়, আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় একটি আঞ্চলিক খাদ্য উপাদান কয়েক বছরের মধ্যেই বৈশ্বিক স্টাইল আইকনে পরিণত হতে পারে; কিন্তু সেই গতিতে কখনোই তাল মিলিয়ে চলতে পারে না খামার, শ্রমিক আর প্রকৃতির ধীর লয়।
Sarakhon Report 


















