আগে যেখানে বন্ধুরা আড্ডায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করত, হাসত, তর্ক করত, এখন সেখানে দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে গেছে। কফিশপ, পার্ক কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় দেখা যায়—একদল বন্ধু একসাথে বসে আছে, কিন্তু সবার চোখ নিচু, হাত ব্যস্ত মোবাইল স্ক্রিনে। মুখোমুখি কথোপকথনের বদলে আঙুল চলছে চ্যাট অ্যাপে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বা ভিডিও স্ক্রলে।
ডিজিটাল বিনোদনের সহজলভ্যতা
ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের মাধ্যমে তরুণরা এখন যেকোনো মুহূর্তে অসংখ্য বিনোদনের উৎসে পৌঁছাতে পারে। ইউটিউব ভিডিও, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম রিলস, অনলাইন গেম—সবই হাতের নাগালে। ফলে বন্ধুদের গল্পের তুলনায় ফোনের কনটেন্ট অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় ও চটকদার মনে হয়।
সামাজিক স্বীকৃতির খোঁজ
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় “লাইক”, “কমেন্ট” ও “শেয়ার” পেয়ে তরুণরা তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি লাভ করে, যা ডোপামিন নামের এক ধরনের ‘ফিল-গুড’ হরমোনের নিঃসরণ ঘটায়। মুখোমুখি আড্ডায় এই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সবসময় মেলে না, কিন্তু অনলাইনে কয়েক সেকেন্ডেই পাওয়া যায়।
মুখোমুখি কথোপকথনের অস্বস্তি
অনেক তরুণ মুখোমুখি আলাপে আত্মবিশ্বাসী নয়। বাস্তব কথোপকথনে অস্বস্তি, দ্বিধা বা ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা থেকে তারা বাঁচতে চায়। স্মার্টফোনে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সময় নিয়ে উত্তর দেওয়া যায়, ভাবনা গুছিয়ে লেখা যায়—ফলে মানসিক চাপ কম থাকে।
তথ্যপ্রবাহের আসক্তি
প্রতিনিয়ত নতুন নোটিফিকেশন, খবর, মেমে বা ভাইরাল ভিডিও তরুণদের মনোযোগ কাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা একে “ডিজিটাল আসক্তি” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই প্রভাব এতটাই প্রবল যে, বন্ধুদের গল্প শোনার সময়ও মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
বাস্তবতা থেকে পালানোর প্রবণতা
পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা সম্পর্কের জটিলতার মতো ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে অনেক তরুণ বাস্তব জীবন থেকে দূরে থাকতে চায়। স্মার্টফোন তাদের জন্য এক ধরনের ‘সেফ জোন’, যেখানে তারা নিজের মতো থাকতে পারে এবং বাস্তবতার চাপ এড়িয়ে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রুবিনা আক্তার বলেন,
“স্মার্টফোন এখন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং তরুণদের সামাজিক পরিচয় ও ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে গেছে। অনলাইনে না থাকলে ‘ফোমো’ (Fear of Missing Out) বা কিছু মিস হয়ে যাওয়ার ভয় তাদের মধ্যে তৈরি হয়।”
মনোবিজ্ঞানী ড. ফারহানা সুলতানা বলেন,
“মানুষ স্বভাবতই সামাজিক প্রাণী, কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যম সেই সামাজিকতার ধরন পাল্টে দিয়েছে। আজকের তরুণরা মুখোমুখি কথা বলার চেয়ে অনলাইনে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, কারণ এতে ঝুঁকি কম, নিয়ন্ত্রণ বেশি এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সুযোগ থাকে।”
সমাধানের পথ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তরুণদের সচেতনভাবে ডিজিটাল ব্যবহারের সীমা নির্ধারণ করা উচিত। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় গেলে ‘ফোন-ফ্রি’ সময় নির্ধারণ, সরাসরি কথোপকথনে অংশ নেওয়া এবং বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে সম্পর্কের উষ্ণতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
তরুণদের অভিজ্ঞতা ও বাস্তব উদাহরণ
ঢাকার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিব হাসান বলেন,
“আমরা ছয়-সাতজন বন্ধু প্রায়ই কফিশপে বসি, কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখি সবাই ফোনে। কখনো মনে হয়, আড্ডায় আসাটা শুধু ছবি তোলার জন্য—ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলেই যেন আড্ডা শেষ।”
চট্টগ্রামের স্কুলছাত্রী নুসরাত জাহান জানান,
“বাস্তবে অনেক কথা বলতে সংকোচ লাগে, কিন্তু মেসেঞ্জারে সব কথা বলা যায়। তাই বন্ধু সামনেই থাকলেও আমরা অনলাইনে চ্যাট করি।”
পঞ্চগড়ের লাবিব আলম বলেন,
“গ্রামে আগে বিকেলে সবাই মাঠে খেলত বা পুকুরপাড়ে বসত। এখন ছেলেরা খেলাধুলা বাদ দিয়ে ফোনে গেম খেলে, আর অনেকেই পাশে বসে থেকেও হেডফোন লাগিয়ে ভিডিও দেখে।”
শিক্ষক ও পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি
রাজশাহীর একটি কলেজের শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন,
“আমাদের শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারছে না। তারা মনে করছে—অনলাইনের সম্পর্কই যথেষ্ট। অথচ বাস্তব জীবনের যোগাযোগের দক্ষতা না থাকলে ভবিষ্যতে কর্মজীবনে সমস্যা হবে।”
ঢাকার অভিভাবক শামীমা আক্তার বলেন,
“আমার দুই ছেলে একই রুমে থেকেও অনলাইনে একে অপরকে মিম পাঠায়। আগে ভাইরা একসাথে খেলাধুলা করত, এখন স্ক্রিন শেয়ার করে গেম খেলে। এতে হাসি-ঠাট্টা কমে গেছে।”
মানবিক বার্তা
সমস্যা শুধু প্রযুক্তির নয়—এটি মানুষের জীবনযাপনের ধরণ ও মানসিকতার পরিবর্তনের ফল। প্রযুক্তি সুবিধা দিলেও, তা যেন মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি না করে। মুখোমুখি হাসি, হাত মেলানো, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা—এসব মানবিক অভিজ্ঞতা কোনো ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যায় না।