এই আগস্টে চীন ও রাশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরে “জয়েন্ট সি-২০২৫” নামের বার্ষিক যৌথ নৌ-মহড়া পরিচালনা করেছে। কিন্তু এই মহড়া শক্তি প্রদর্শনের চেয়ে বেশি কিছু দেখিয়েছে—সিনো-রুশ সামরিক সম্পর্কে যে তীব্র অসমতা তৈরি হয়েছে, তা স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। যে মঞ্চ এক সময় যৌথ সক্ষমতা দেখানোর ছিল, সেটিই এখন রাশিয়ার নৌ-অবক্ষয় এবং বেইজিংয়ের ওপর তার বেড়ে যাওয়া কৌশলগত নির্ভরতার জানালা হয়ে উঠেছে।
এ বছরের মহড়া থেকে মূল শিক্ষা হলো কী করা হয়েছে তা নয়—বরং কী করা হয়নি। এই প্রথম রাশিয়া একটি বড় আকারের যুদ্ধজাহাজও পাঠাতে পারেনি—না কোনো ক্রুজার, না আধুনিক ডেস্ট্রয়ার। বিপরীতে, চীন পাঠিয়েছে আধুনিকতম টপ-লাইন জাহাজ নিয়ে গঠিত একটি অগ্রগামী টাস্ক ফোর্স, যা দূরপাল্লার সমন্বয় ও শক্তি প্রদর্শনের সক্ষমতা দেখিয়েছে। বিস্তৃত এই নৌ-অসমতা শুধু আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিতই দেয় না, বরং এও বোঝায় যে চীনের বাড়তে থাকা বৈশ্বিক প্রভাব ঠেকাতে রাশিয়াকে বেইজিং থেকে আলাদা করে আনা—এমন কোনো মার্কিন আশা বাস্তবে নিরর্থক।
২০১২ সাল থেকে রাশিয়া ও চীন প্রতিবছর যৌথ মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরবর্তী মহড়াগুলোর সঙ্গে ২০২৫ সালের রুশ অংশগ্রহণের তুলনা করলে পার্থক্য চোখে পড়ে। ২০২২ সালে রাশিয়া পাঠিয়েছিল ক্ষেপণাস্ত্র ক্রুজার “ভারিয়াগ”, ডেস্ট্রয়ার “মার্শাল শাপোশনিকভ” এবং একাধিক আধুনিক করভেট। ২০২৩ সালে জাপান সাগরে “নর্দার্ন/জয়েন্ট-২০২৩” মহড়ায় রাশিয়া সাবমেরিন, ডুবোজাহাজ-বিধ্বংসী জাহাজ এবং নানা রকম আকাশযান যুক্ত করেছিল। এমনকি ২০২৪ সালেও, বৃহৎ “ওশান-২০২৪” মহড়ার অংশ হিসেবে রুশ প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর বড় ডুবোজাহাজ-বিধ্বংসী জাহাজ মোতায়েন করে চীনা আকাশ ও নৌবাহিনীর সঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকায় সমন্বয় চালায়। কিন্তু ২০২৫ সালে মস্কো যা জোগাড় করতে পেরেছে, তা হলো একটি পুরোনো ডুবোজাহাজ-বিধ্বংসী জাহাজ “অ্যাডমিরাল ত্রিবুত্স”, একটি হালকা করভেট “লাউদ” এবং একটি উদ্ধার জাহাজ “বেলৌসোভ”—এতে কি একটি বৈশ্বিক নৌ-শক্তির প্রোফাইল ধরা পড়ে?

রাশিয়ার পতন শুধু সম্পদের ঘাটতি নয়, কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার ফল। ইউক্রেনে দীর্ঘ যুদ্ধ রাশিয়ার ব্ল্যাক সি ফ্লিটকে নাজেহাল করেছে; অনুমান করা হয়, ইউক্রেন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জাহাজ নষ্ট বা অক্ষম করে দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞা নতুন জাহাজ বানানো বা পুরোনো জাহাজের মেরামতকে কঠিন করে তুলেছে, ফলে সব নৌবহরেই হার্ডওয়্যারের সংকট। জুলাইয়ের শুরুর দিকে, খবর অনুযায়ী, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আট বছর ধরে ব্যর্থ মেরামতের পর দেশের একমাত্র বিমানবাহী রণতরীটি ত্যাগ করার কথাও বিবেচনা করেছে।
সম্প্রতি রাশিয়াকে নৌবাহিনী দিবসের স্মারক কুচকাওয়াজ বাতিল করতে হয়েছে—সম্ভবত ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলার আশঙ্কায়। একসময় পূর্ব দিগন্তে রাশিয়ার কৌশলগত স্তম্ভ হিসেবে কল্পিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরটি এখন মূলত সোভিয়েত আমলের পুরোনো সম্পদের ওপর দাঁড়িয়ে, যার দূরসমুদ্র অপারেশনের সক্ষমতা সীমিত। নতুন জাহাজগুলোকে আর্কটিক ও ব্ল্যাক সি মোতায়েনের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, যা এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে ঘোষিত কৌশলগত ফোকাসের সঙ্গে খাপ খায় না।
চীনের পন্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিং যৌথ মহড়ায় অংশগ্রহণের পরিসর ও জটিলতা দুদিকেই ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি করেছে। ২০২৫ সালে চীন পাঠিয়েছে বিশালাকৃতির টাইপ ০৫৫ “শাওশিং” ডেস্ট্রয়ার—যা চীনের সবচেয়ে বড় ও উন্নত—সঙ্গে টাইপ ০৫২ডি “উরুমকি”, সহায়ক জাহাজ, হেলিকপ্টার ও মেরিন—সব মিলিয়ে কার্যত বিমানবাহী রণতরীভিত্তিক একটি পূর্ণাঙ্গ টাস্ক ফোর্স গড়ে তুলেছে। চীনা নৌবাহিনী এখন নিয়মিতভাবে সমন্বিত নৌবহর-যুদ্ধ, দূরপাল্লার আঘাত-সমন্বয় এবং আঞ্চলিক অভিযানে প্রশিক্ষণ করে। প্রতিটি মহড়াই তাদের যৌথ কমান্ড দক্ষতা ও সামুদ্রিক পরিসরকে আরও গভীর করে।

এতে প্রমাণিত হয় যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের নৌবাহিনী যুদ্ধক্ষমতা, উন্নত প্ল্যাটফর্ম ও গভীর সমুদ্রে মোতায়েনযোগ্যতার দিক থেকে দ্রুত প্রসারিত হয়েছে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি তাদের “কার্যকর অপারেশনের জন্য চিহ্নিত” যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৩৯৫—দশ বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। চীনের এখন দুটি বিমানবাহী রণতরী আছে—লিয়াওনিং ও শানডং। তৃতীয়টি, ফুজিয়ান, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট লঞ্চারে সজ্জিত প্রথম চীনা রণতরী। সমুদ্র-পরীক্ষা সম্পন্ন করে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ এটি অপারেশনাল সার্ভিসে প্রবেশ করবে বলে ধারণা।
জুন মাসে, প্রতিবেদনে এসেছে, লিয়াওনিং প্রথমবারের মতো এক নৌ-মহড়ায় জাপান উপকূলের বাইরে দ্বিতীয় দ্বীপশৃঙ্খল অতিক্রম করেছে। চীনের কাছে আরও বিপুলসংখ্যক আধুনিক যুদ্ধজাহাজ রয়েছে—টাইপ ০৫২ডি ডেস্ট্রয়ার, টাইপ ০৫৫ রেনহাই-শ্রেণির ডেস্ট্রয়ার এবং টাইপ ০৭৫ উভচর আক্রমণ জাহাজ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
২০২৫ সালের মহড়ার প্রতীকী তাৎপর্যও উপেক্ষা করা যায় না। চীনের জন্য এটি ছিল প্রাধান্য ও কৌশলগত স্থিতিশীলতার বার্তা দেওয়ার সুযোগ। রাশিয়ার জন্য এটি ছিল এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মোকাবিলা করার কৌশলগত প্রয়োজন—কারণ বাল্টিক ও ব্ল্যাক সি-র ঐতিহ্যগত সমুদ্রপথ ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান এবং ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় জটিল হয়ে পড়েছে। কিন্তু মহড়াটি অপ্রত্যাশিতভাবে হার্ডওয়্যার, প্রশিক্ষণের গতি ও অপারেশনাল পরিসরে এমন এক অসমতা উন্মোচন করেছে যে পুরো ব্যবস্থাটি সমান অংশীদারের যৌথ অনুশীলনের চেয়ে চীনের নেতৃত্বে এক নির্ভরশীল সঙ্গীর সঙ্গে মহড়ার মতোই দেখিয়েছে।
রাশিয়া এই অসমতা বুঝতে পারছে বলেই মনে হয়। এ বছরের শুরুর গ্রীষ্মে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন “২০৫০ সাল পর্যন্ত রুশ নৌবাহিনী উন্নয়ন কৌশল” অনুমোদন করেছেন—যা নৌ-শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা। তিনি নতুন প্রজন্মের নৌ-শক্তি উন্নয়নে গতি আনার এবং জাহাজ নির্মাণে শিল্পগত স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার সামরিক প্রযুক্তিকেও শক্তিশালী করছে—সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার “চোয়ে হিয়ন”-শ্রেণির একটি ডেস্ট্রয়ার উদ্বোধন তারই উদাহরণ। কিন্তু ২০৫০ সালের লক্ষ্যমাত্রা বা আরও দুর্বল উত্তর কোরিয়ান নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ—কোনোটাই বর্তমান বাস্তবতাকে ঢাকতে পারে না: রাশিয়ার নৌবাহিনী হিমশিম খাচ্ছে, আর চীনের নৌগত অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা মস্কোর নেই—প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো দূরের কথা।

ভূগোলও এখন রাশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় শক্তি হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতার বিরুদ্ধে কাজ করছে। এ গ্রীষ্মে কামচাটকা উপদ্বীপে মাত্রা ৮.৮-এর এক বিধ্বংসী ভূমিকম্প আঘাত হানে—যেখানে রাশিয়ার কৌশলগত সাবমেরিনগুলোর বড় অংশ, যেমন বোরেই ও ইয়াসেন-শ্রেণির পারমাণবিক সাবমেরিন, অবস্থান করে। বড় ধরনের ক্ষতি নিশ্চিত না হলেও, সম্প্রতি ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় রাশিয়ার দূরপাল্লার কৌশলগত বোমারু বিমানের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ায় মস্কোকে আরও বেশি কৌশলগত সম্পদ দূরপ্রাচ্যে সরিয়ে নিতে হয়েছে। পরিহাস হলো—এই সম্পদগুলো রক্ষার প্রয়োজনই রাশিয়ার বিদেশে নৌ-শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতাকে আরও সীমাবদ্ধ করতে পারে।
এসব মিলিয়ে যে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা সামনে আসে তা হলো: এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চ্যালেঞ্জ জানাতে রাশিয়ার যে কৌশলগত উদ্দেশ্য, তা ক্রমশ চীনা অবকাঠামো, লজিস্টিক্স ও কূটনৈতিক আশ্রয়ের সঙ্গে আরও আঁটসাঁটভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। আঞ্চলিক সমুদ্রপথে বেইজিং যখন নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করছে এবং জাহাজ নির্মাণে প্রাধান্য বিস্তার করছে, তখন মস্কো সামরিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত—সব দিক থেকেই এক নির্ভরশীল অংশীদারে রূপ নিচ্ছে।
এই বাড়তে থাকা অসমতা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত হিসাবকেও নতুন অর্থ দেয়। বছরের পর বছর কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন, ওয়াশিংটন চীন-রাশিয়ার ভেতরে ফাটল ধরাতে পারবে—তাদের ভিন্ন স্বার্থকে কাজে লাগিয়ে এই সমীকরণ দুর্বল করবে। কিন্তু রাশিয়ার দৃশ্যমান নৌ-অক্ষমতা ভিন্ন বার্তা দেয়। মস্কোর আর চীনা উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা নেই, এশিয়া-প্রশান্তে স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার স্বায়ত্তশাসনও নেই। সম্ভাব্য “ভারসাম্যকারী” নয়, রাশিয়া এখন কাঠামোগতভাবে এক নির্ভরশীল অংশীদার।
শেষ পর্যন্ত “জয়েন্ট সি-২০২৫” কোনো যুদ্ধের মহড়া ছিল না—এটি ছিল এক নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থার পূর্বাভাস। আত্মবিশ্বাসী ও আঞ্চলিক নৌ-শ্রেণিবিন্যাসের শীর্ষে উঠতে থাকা চীন কার্যত যৌথ কমান্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিধ্বস্ত ও ক্ষয়প্রাপ্ত রাশিয়া তা অনুসরণ করছে—পছন্দ থেকে নয়, প্রয়োজনের তাগিদে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এই বাস্তবতা আত্মস্থ করা উচিত: চীন-রাশিয়া সম্পর্ক সমতার নয়, বরং বাড়তে থাকা অসমতা ও নির্ভরতার।
লেখক: হাও নান, চাহার ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফেলো এবং প্লাউশেয়ারস ফান্ড ও হরাইজন ২০৪৫-এর ২০২৫-২০২৬ মেয়াদের নিউক্লিয়ার ফিউচারস ফেলো।
হাও নান 


















