চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা, সাকিব আল হাসান, জয়া আহসানসহ একাধিক শিল্পী-সংস্কৃতিসেবীর ছবিতে জুতা নিক্ষেপ কর্মসূচি পালনের খবরটি আমাদের সামনে কি বার্তা দিচ্ছে? এই ঘটনাটিকে একটি সাময়িক উত্তেজনা মনে করলে ভুল হবে, বরং এটি আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক মানসিকতার এক গভীর অবক্ষয়ের সংকেত। ইতিহাস, রাজনীতি আর সংস্কৃতির প্রশ্নে আমরা ক্রমেই বিভাজিত হয়ে পড়ছি। কারও প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বা স্মরণকেও এখন অপরাধ বা অপর পক্ষের প্রতি অবস্থান হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। অথচ একটি সভ্য সমাজে স্মরণ করা, শ্রদ্ধা জানানো কিংবা সমালোচনা করা—সবকিছুরই জায়গা থাকে। প্রশ্ন হলো: আমরা কি সেই জায়গাটা হারিয়ে ফেলছি?
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিরোধিতা নতুন কিছু নয়। ষাটের দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রতিটি সময়েই রাজনীতি ছিল দ্বিধাবিভক্ত। কিন্তু তখনও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক জগতে কিছুটা মানবিকতা রক্ষা পেত। আজ সেই মানবিকতাই ভেঙে পড়েছে। আমরা এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছি যেখানে কেউ যদি বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানান, তবে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ‘আওয়ামীপন্থী’ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন; কেউ শেখ হাসিনার সমালোচনা করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ‘বিএনপির এজেন্ট’ হয়ে যান। ভিন্নমতকে শুধু অস্বীকার করা নয়, বরং তাকে অপমান, হেয়প্রতিপন্ন বা নিঃশেষ করার চেষ্টাই এখন রাজনীতির মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

সহনশীলতা হলো গণতন্ত্রের মূল প্রাণ। ভিন্নমতকে যদি আমরা সহ্যই করতে না পারি, তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অর্থই থাকে না। চট্টগ্রামে যা হলো—তা মূলত ভিন্ন মতকে মেনে নেওয়ার অক্ষমতার প্রকাশ। যিনি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করছেন, তাঁকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভেবে জুতাপেটা করা হলো। কিন্তু সত্যিই কি এর মাধ্যমে কোনো ইতিবাচক বার্তা দেওয়া সম্ভব? নাকি সমাজে ঘৃণা ও প্রতিশোধের আগুন আরও জ্বালিয়ে দেওয়া হলো?
যে ব্যানারে ছবি টানানো হয়েছে, সেখানে শুধু রাজনীতিকরা নন—অভিনেতা, গায়ক, সাংবাদিক, শিক্ষকও ছিলেন। তাঁরা কেউ সক্রিয় রাজনীতির অংশ নন, অনেকেই কেবল ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেই সামান্য মতপ্রকাশের কারণেই তাঁদের ছবি জুতাপেটার তালিকায় ঢুকেছে। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি—আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও আর নিরাপদ নেই। শিল্প-সংস্কৃতি, যা আসলে মানুষের মধ্যে মানবিকতা ও সৌন্দর্যবোধ তৈরি করার কথা, সেটিও এখন রাজনীতির অন্ধ প্রতিশোধপরায়ণতার বলি হচ্ছে।
এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে—শিল্পী, সাহিত্যিক, ক্রীড়াবিদ, শিক্ষকরা কি তাঁদের রাজনৈতিক মত প্রকাশের অধিকার হারিয়েছেন? একজন শিল্পী যদি বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানান, তবে কি তাঁর শিল্পের মূল্য কমে যাবে? একজন ক্রীড়াবিদ যদি শেখ হাসিনাকে নিয়ে ইতিবাচক কিছু লেখেন, তবে কি তাঁর ক্রীড়া-অর্জন মুছে যাবে? যদি আমরা এভাবে রাজনীতির মাপকাঠিতে সংস্কৃতির মানুষকে বিচার করতে থাকি, তবে আমাদের সমাজ অচিরেই এক ভয়ংকর সাংস্কৃতিক দারিদ্র্যের দিকে চলে যাবে—যেখানে শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, ক্রীড়া সবকিছু কেবল দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে পরিমাপ করা হবে।

এ ঘটনায় লক্ষ্যণীয় যে ব্যানারে লেখা ছিল ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী ছাত্রজনতা’। তরুণদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো আন্দোলনই সম্ভব নয়। কিন্তু তরুণরা যদি কেবল ঘৃণা, প্রতিশোধ আর অপমানের পথেই রাজনীতি শিখে, তবে তারা ভবিষ্যতে কী নির্মাণ করবে? একটি গণতান্ত্রিক সমাজ, নাকি আরেকটি প্রতিশোধপরায়ণ ও বিভক্ত সমাজ? তরুণদের সামনে এখন সুযোগ আছে ঘৃণার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার। ভিন্নমতের মানুষকে যুক্তির মাধ্যমে মোকাবিলা করতে শেখা, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে পাল্টা জবাব দেওয়া, শালীন প্রতিবাদ করা—এসবই তাঁদের সংস্কৃতি হতে হবে। কারণ আজকের তরুণই আগামী দিনের রাজনীতির নেতৃত্ব দেবে। তারা যদি সহনশীলতা না শিখে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও ভয়ংকর বিভক্তির মধ্যে বড় হবে।
এ ঘটনার পর আমাদের সবারই আত্মজিজ্ঞাসা করা দরকার—এই পথ কি আমাদের কোথাও নিয়ে যাবে? কারও প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, ইতিহাস স্মরণ করা, ব্যক্তিগত মত প্রকাশ—এসব যদি অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়, তবে এর শেষ কোথায়? আগামী দিনে কি শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া নিয়েও বিভাজন তৈরি হবে? মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানানোও কি তখন প্রশ্নবিদ্ধ হবে? আমরা যদি একটি সভ্য, গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ চাই, তবে আমাদের রাজনীতির ভাষা পাল্টাতে হবে। ঘৃণা দিয়ে নয়, যুক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হবে। শিল্পী, লেখক, ক্রীড়াবিদ—তাঁরা সমাজের আলো; তাঁদেরকে রাজনৈতিক প্রতিশোধের কাদায় টেনে নামানো মানে নিজের আলো নেভানো। আমাদের প্রয়োজন শ্রদ্ধা, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া। নইলে আমরা সবাই মিলে একটি অন্ধকার সমাজের দিকে হাঁটব, যেখানে শুধু ঘৃণা আর অপমানের প্রতিধ্বনি বাজবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনীতি ও সমাজনীতি বিষয়ক বিশিষ্ট বিশ্লেষক
বিভূরঞ্জন সরকার 


















