১০:৫৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫
সৌদিতে বিরল তুষারপাতের পর প্রশ্ন: সংযুক্ত আরব আমিরাতেও কি আবার তুষারপাত সম্ভব? যে রিকশায় গুলিবিদ্ধ হন হাদি, সেই চালকের আদালতে জবানবন্দি তারেক রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনে আমরা জয়ী হবো: মির্জা ফখরুল পারমাণবিক সাবমেরিন থেকে কে-৪ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা ভারতের তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনে বহুদলীয় গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে: নাহিদ ঢাকা-১৫ আসনে জামায়াত আমিরের পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ মগবাজারে ককটেল বিস্ফোরণে শ্রমিক নিহত, অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা নির্বাচনপ্রত্যাশীদের জন্য অনলাইনে কর রিটার্ন দাখিলে বিশেষ ব্যবস্থা এনবিআরের মাকে দেখতে এভারকেয়ার হাসপাতালে তারেক রহমান মিয়ানমারের অসম্পূর্ণ সাধারণ নির্বাচন: জানা দরকার পাঁচটি বিষয়

যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল কাটা: অপুষ্ট শিশুদের জন্য বৈশ্বিক সংকট

নাইজেরিয়ায় মায়েদের দীর্ঘ অপেক্ষা
গত নভেম্বরে নাইজেরিয়ার মাইদুগুরিতে নারী ও শিশুদের ভিড় জমেছিল পুষ্টি কেন্দ্রে। তারা ভোর থেকে লাইন ধরেছিল হাতে ক্ষুধার্ত ও হাড্ডিসার সন্তান নিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর মিলছিল ছোট্ট লাল রঙের এক প্যাকেট—যেখানে ছিল বিশেষ পুষ্টিকর পেস্ট। এই খাবারই শিশুদের মৃত্যুসীমা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারত।
শিশুরা অস্বাভাবিকভাবে নিশ্চল—দৌড়ায় না, হাসে না, এমনকি মুখে ভনভন করা মাছিকেও তাড়াতে পারছিল না। দুই বছরের ফাতিমা, যার ওজন ছিল মাত্র ৭ কেজি, মায়ের কোলেই দুর্বল হয়ে ঝুলে ছিল।

মার্কিন সহায়তা বন্ধ, জীবনরক্ষাকারী খাদ্য ঘাটতি
এই শিশুদের জন্য ‘রেডি-টু-ইউজ থেরাপিউটিক ফুড’ (RUTF) ছিল ভরসা। প্রতি প্যাকেটের দাম ৩০ সেন্টেরও কম, যাতে থাকে চিনাবাদাম, দুধগুঁড়া, চিনি, তেল ও ভিটামিন–খনিজ। ছয় সপ্তাহের চিকিৎসার খরচ হয় ৪৫ ডলারেরও কম।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (USAID) বিলুপ্ত করার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। আগে এই সংস্থা বিশ্বের প্রায় অর্ধেক থেরাপিউটিক খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করত। এখন ছয় মাস কেটে গেছে মার্কিন সহায়তা বন্ধ হওয়ার পর, ফলে বহু ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেছে, বাকিগুলোতে মজুদ প্রায় শেষ।

সীমিত অর্থায়ন, বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি
২০২৪ সালে ইউএসএইড ২০০ মিলিয়ন ডলারের মতো ব্যয় করেছিল এ খাতে। কিন্তু ২০২৫ সালের জন্য এখনো তহবিল ছাড়া হয়নি। গত মাসে ইউনিসেফকে নতুন করে ৯৩ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হলেও তা আগের অঙ্কের অর্ধেক।
সরকার দাবি করছে, পুষ্টি কর্মসূচি এখনো অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তবে তারা বলছে, “জাতীয় সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।”
অন্যদিকে সহায়তা সংস্থাগুলোর মতে, তহবিল বিলম্বের কারণে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার শিশু মৃত্যুর ঝুঁকিতে আছে। নাইজেরিয়ায় জুলাই শেষে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ১৫০টি ক্লিনিক বন্ধ হয়েছে। কেবল একটি প্রদেশে হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ১৭টির মধ্যে ১৬টি কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে।

বিশ্বজুড়ে চিকিৎসাকেন্দ্র বন্ধ
শুধু আফ্রিকাই নয়—চাদ, মালি, নাইজার, সিরিয়া, বুরকিনা ফাসো, কেনিয়া, দক্ষিণ সুদান, আফগানিস্তান, নেপালসহ এক ডজনের বেশি দেশে খাদ্য ঘাটতি বা চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেছে।
আফগানিস্তানে ৯ লাখ শিশুর চিকিৎসার প্রয়োজন থাকলেও গুদামে কিছুই নেই। নেপালে অর্ধেক প্রদেশে সরবরাহ নেই, শিগগিরই সারা দেশে সংকট দেখা দেবে—২ লাখ শিশু ঝুঁকিতে।

মানবিক সংকট আরও গভীর হচ্ছে
এইড গ্রুপগুলোর হিসাব অনুযায়ী, যদি এ অবস্থা চলতে থাকে তবে প্রতিবছর ১.৬ লাখ শিশুর মৃত্যু হতে পারে। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ৪ কোটি ৩০ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।
অপুষ্টির প্রথম ১,০০০ দিন মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় চিকিৎসা না হলে শিশুর মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দুর্বলতা এবং মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বাড়ে।

সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ার প্রভাব
আগে আমেরিকান কৃষকরা চিনাবাদাম, দুধগুঁড়া, সয়াবিন সরবরাহ করত। উৎপাদিত পণ্য জাহাজে করে আফ্রিকা পাঠানো হতো। এখন তহবিল বন্ধ ও ইউএসএইড ভেঙে দেওয়ায় পুরো প্রক্রিয়া অচল।
জাতিসংঘ বলছে, নতুন তহবিল দিয়েও অন্তত দুই-তিন মাস সময় লাগবে খাদ্য পৌঁছাতে। দক্ষিণ সুদানের মতো দেশে রাস্তার দুরবস্থার কারণে তিন মাস পর্যন্ত দেরি হয়। আফগানিস্তানে পৌঁছাতে সময় লাগতে পারে আট-নয় মাস—যা অনেক শিশুর জন্য অনেক দেরি।

সংকট মোকাবিলায় বেসরকারি প্রচেষ্টা
কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের অর্থে কার্যক্রম চালাচ্ছে। মানা কোম্পানি এক ব্রিটিশ দাতার কাছ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে, যা দিয়ে ইউনিসেফকে পাঁচ লাখ প্যাকেট দিয়েছে। এডেসিয়া ২০ লাখ ডলার সংগ্রহ করে কিছু সরবরাহ নিজ উদ্যোগে পাঠাচ্ছে।
তবুও তারা সতর্ক করেছে—অর্থ না এলে কৃষকদের কাছ থেকে কাঁচামাল কেনার সামর্থ্য থাকবে না। ইতিমধ্যেই কয়েকটি ছোট সংস্থা ভেঙে পড়েছে।

উপসংহার
বিশ্বজুড়ে অপুষ্ট শিশুদের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা থাকলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে তা তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। নাইজেরিয়ার ফাতিমার মতো অসংখ্য শিশুর জীবন এখন তহবিল সিদ্ধান্তের ওপর ঝুলছে। সংকট যদি দ্রুত না সামাল দেওয়া হয়, তবে আগামী মাসগুলোতে হাজার হাজার শিশু অকালেই প্রাণ হারাবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সৌদিতে বিরল তুষারপাতের পর প্রশ্ন: সংযুক্ত আরব আমিরাতেও কি আবার তুষারপাত সম্ভব?

যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল কাটা: অপুষ্ট শিশুদের জন্য বৈশ্বিক সংকট

০১:০৮:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫

নাইজেরিয়ায় মায়েদের দীর্ঘ অপেক্ষা
গত নভেম্বরে নাইজেরিয়ার মাইদুগুরিতে নারী ও শিশুদের ভিড় জমেছিল পুষ্টি কেন্দ্রে। তারা ভোর থেকে লাইন ধরেছিল হাতে ক্ষুধার্ত ও হাড্ডিসার সন্তান নিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর মিলছিল ছোট্ট লাল রঙের এক প্যাকেট—যেখানে ছিল বিশেষ পুষ্টিকর পেস্ট। এই খাবারই শিশুদের মৃত্যুসীমা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারত।
শিশুরা অস্বাভাবিকভাবে নিশ্চল—দৌড়ায় না, হাসে না, এমনকি মুখে ভনভন করা মাছিকেও তাড়াতে পারছিল না। দুই বছরের ফাতিমা, যার ওজন ছিল মাত্র ৭ কেজি, মায়ের কোলেই দুর্বল হয়ে ঝুলে ছিল।

মার্কিন সহায়তা বন্ধ, জীবনরক্ষাকারী খাদ্য ঘাটতি
এই শিশুদের জন্য ‘রেডি-টু-ইউজ থেরাপিউটিক ফুড’ (RUTF) ছিল ভরসা। প্রতি প্যাকেটের দাম ৩০ সেন্টেরও কম, যাতে থাকে চিনাবাদাম, দুধগুঁড়া, চিনি, তেল ও ভিটামিন–খনিজ। ছয় সপ্তাহের চিকিৎসার খরচ হয় ৪৫ ডলারেরও কম।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (USAID) বিলুপ্ত করার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। আগে এই সংস্থা বিশ্বের প্রায় অর্ধেক থেরাপিউটিক খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করত। এখন ছয় মাস কেটে গেছে মার্কিন সহায়তা বন্ধ হওয়ার পর, ফলে বহু ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেছে, বাকিগুলোতে মজুদ প্রায় শেষ।

সীমিত অর্থায়ন, বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি
২০২৪ সালে ইউএসএইড ২০০ মিলিয়ন ডলারের মতো ব্যয় করেছিল এ খাতে। কিন্তু ২০২৫ সালের জন্য এখনো তহবিল ছাড়া হয়নি। গত মাসে ইউনিসেফকে নতুন করে ৯৩ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হলেও তা আগের অঙ্কের অর্ধেক।
সরকার দাবি করছে, পুষ্টি কর্মসূচি এখনো অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তবে তারা বলছে, “জাতীয় সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।”
অন্যদিকে সহায়তা সংস্থাগুলোর মতে, তহবিল বিলম্বের কারণে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার শিশু মৃত্যুর ঝুঁকিতে আছে। নাইজেরিয়ায় জুলাই শেষে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ১৫০টি ক্লিনিক বন্ধ হয়েছে। কেবল একটি প্রদেশে হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ১৭টির মধ্যে ১৬টি কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে।

বিশ্বজুড়ে চিকিৎসাকেন্দ্র বন্ধ
শুধু আফ্রিকাই নয়—চাদ, মালি, নাইজার, সিরিয়া, বুরকিনা ফাসো, কেনিয়া, দক্ষিণ সুদান, আফগানিস্তান, নেপালসহ এক ডজনের বেশি দেশে খাদ্য ঘাটতি বা চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেছে।
আফগানিস্তানে ৯ লাখ শিশুর চিকিৎসার প্রয়োজন থাকলেও গুদামে কিছুই নেই। নেপালে অর্ধেক প্রদেশে সরবরাহ নেই, শিগগিরই সারা দেশে সংকট দেখা দেবে—২ লাখ শিশু ঝুঁকিতে।

মানবিক সংকট আরও গভীর হচ্ছে
এইড গ্রুপগুলোর হিসাব অনুযায়ী, যদি এ অবস্থা চলতে থাকে তবে প্রতিবছর ১.৬ লাখ শিশুর মৃত্যু হতে পারে। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ৪ কোটি ৩০ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।
অপুষ্টির প্রথম ১,০০০ দিন মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় চিকিৎসা না হলে শিশুর মস্তিষ্কে স্থায়ী ক্ষতি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দুর্বলতা এবং মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বাড়ে।

সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ার প্রভাব
আগে আমেরিকান কৃষকরা চিনাবাদাম, দুধগুঁড়া, সয়াবিন সরবরাহ করত। উৎপাদিত পণ্য জাহাজে করে আফ্রিকা পাঠানো হতো। এখন তহবিল বন্ধ ও ইউএসএইড ভেঙে দেওয়ায় পুরো প্রক্রিয়া অচল।
জাতিসংঘ বলছে, নতুন তহবিল দিয়েও অন্তত দুই-তিন মাস সময় লাগবে খাদ্য পৌঁছাতে। দক্ষিণ সুদানের মতো দেশে রাস্তার দুরবস্থার কারণে তিন মাস পর্যন্ত দেরি হয়। আফগানিস্তানে পৌঁছাতে সময় লাগতে পারে আট-নয় মাস—যা অনেক শিশুর জন্য অনেক দেরি।

সংকট মোকাবিলায় বেসরকারি প্রচেষ্টা
কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের অর্থে কার্যক্রম চালাচ্ছে। মানা কোম্পানি এক ব্রিটিশ দাতার কাছ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে, যা দিয়ে ইউনিসেফকে পাঁচ লাখ প্যাকেট দিয়েছে। এডেসিয়া ২০ লাখ ডলার সংগ্রহ করে কিছু সরবরাহ নিজ উদ্যোগে পাঠাচ্ছে।
তবুও তারা সতর্ক করেছে—অর্থ না এলে কৃষকদের কাছ থেকে কাঁচামাল কেনার সামর্থ্য থাকবে না। ইতিমধ্যেই কয়েকটি ছোট সংস্থা ভেঙে পড়েছে।

উপসংহার
বিশ্বজুড়ে অপুষ্ট শিশুদের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা থাকলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে তা তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। নাইজেরিয়ার ফাতিমার মতো অসংখ্য শিশুর জীবন এখন তহবিল সিদ্ধান্তের ওপর ঝুলছে। সংকট যদি দ্রুত না সামাল দেওয়া হয়, তবে আগামী মাসগুলোতে হাজার হাজার শিশু অকালেই প্রাণ হারাবে।