স্থানীয়দের পর্যটনে অনাগ্রহ
সিঙ্গাপুরে নতুন নতুন বিশ্বমানের পর্যটনকেন্দ্র চালু হলেও অনেক স্থানীয় বাসিন্দা মনে করছেন, টিকিটের উচ্চমূল্য তাদেরকে এ ধরনের জায়গায় যেতে নিরুৎসাহিত করছে। কোভিড-১৯ মহামারির আগে গৃহিণী এস্থার লিম সর্বশেষ স্থানীয় কোনো আকর্ষণীয় স্থানে গিয়েছিলেন, তখন তিনি বিদেশ থেকে আসা এক বন্ধুকে নাইট সাফারিতে নিয়ে যান। ২০২০ সালে তিনি সরকারি SingapoRediscovers ভাউচার ব্যবহার করে পরিবারসহ সিঙ্গাপুরের দক্ষিণ দ্বীপপুঞ্জ ঘুরে দেখেছিলেন।
তবে লিম বলেন, বর্তমানে প্রবেশমূল্য এতটাই বেশি যে তিনি আর স্থানীয় ভ্রমণে আগ্রহী নন। তার ভাষায়, “টিকিটই বড় ব্যয়, এর সঙ্গে যাতায়াত ও খাবারের খরচ মিলে খরচ বেড়ে যায়।” তিনি প্রস্তাব দেন যে SG60 ভাউচারগুলো যদি টিকিটের জন্য ব্যবহার করা যেত, তবে স্থানীয়দের জন্য ভ্রমণ অনেক সহজ হতো।
নতুন আকর্ষণ আর বিনিয়োগ
২০২৫ সালে কয়েকটি বড় আকর্ষণীয় কেন্দ্র চালু হয়েছে—Mandai Wildlife Group-এর Rainforest Wild Asia, রিসর্ট ওয়ার্ল্ড সেন্তোসায় Singapore Oceanarium, এবং ইউনিভার্সাল স্টুডিওস সিঙ্গাপুরে Minion Land। এসবের পাশাপাশি দুটি বড় রিসর্ট নতুন করে কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঘোষণা করেছে।
তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এগুলো কি সাধারণ সিঙ্গাপুরবাসীর জন্য সাশ্রয়ী? গত জুলাইয়ে স্থানীয় সংবাদপত্রে চিঠি পাঠিয়ে কয়েকজন নাগরিক বলেন, স্কুলের ছুটির সময় ছাড় দেওয়া বা SG60 ভাউচার দিয়ে জাদুঘর, চিড়িয়াখানা বা Gardens by the Bay-এর টিকিট কেনার সুযোগ থাকলে তা পরিবারগুলোর জন্য উপকারী হতো।

বিশ্ব র্যাংকিংয়ে সিঙ্গাপুর
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৪ সালের ভ্রমণ ও পর্যটন সূচকে অবকাঠামো ও সেবার মানের দিক থেকে ১১৯টি দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুরকে সেরা বলা হয়েছে। কিন্তু মূল্য প্রতিযোগিতার দিক থেকে দেশটি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায়ও এখানে ভ্রমণ ব্যয়বহুল।
সরকারের অবস্থান
সিঙ্গাপুর ট্যুরিজম বোর্ড (STB) জানিয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে তারা “কোয়ালিটি ট্যুরিজম” কৌশল অনুসরণ করছে, যেখানে লক্ষ্য হলো কম খরচ নয়, বরং বেশি মূল্য সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বমানের অভিজ্ঞতা দেওয়া। তাদের মতে, সিঙ্গাপুর কখনোই কম দামের পর্যটন গন্তব্য হতে পারবে না, বরং বিশ্বমান বজায় রাখাই মূল লক্ষ্য।
এ কারণেই স্থানীয় আকর্ষণগুলো নিয়মিত নতুনত্ব আনছে। যেমন, সেন্তোসায় হ্যারি পটার-থিমযুক্ত আকর্ষণ, গার্ডেনস বাই দ্য বে-তে জুরাসিক ওয়ার্ল্ডের অ্যানিম্যাট্রনিক ডাইনোসর, কিংবা সিঙ্গাপুর ফ্লায়ারে দক্ষিণ কোরীয় ব্র্যান্ড Wiggle Wiggle-এর সহযোগিতায় নতুন সাজ।

স্থানীয়দের জন্য ছাড় ও অফার
স্থানীয়দের জন্য নানা ছাড়ের ব্যবস্থাও রয়েছে।
- • Mandai Wildlife Reserve বয়স্ক নাগরিকদের জন্য SG60 অফারে মাত্র ৬০ ডলারে তাদের পাঁচটি পার্ক ঘোরা যায়, যেখানে স্বাভাবিক খরচ ২৩৫ ডলার। ইতিমধ্যে ১০,০০০ এর বেশি প্রবীণ এই সুবিধা নিয়েছেন।
- • রিসর্ট ওয়ার্ল্ড সেন্তোসা তাদের USS সিজন পাস ফিরিয়ে এনেছে ১৬০ ডলারে, যা ছয় মাসে অসীমবার প্রবেশের সুযোগ দেয়।
- • Mount Faber Leisure Group স্থানীয়দের জন্য ক্যাবল কার টিকিট মাত্র ৪ ডলারে দিচ্ছে, যেখানে বিদেশিদের জন্য তা ১৭ ডলার।
তবে সরকার জানিয়েছে, SG60 ভাউচার মূলত দৈনন্দিন খরচে সহায়তা করার জন্য, তাই এগুলো পর্যটনকেন্দ্রে ব্যবহারযোগ্য নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের অধ্যাপক লাউ কং চিন মনে করেন, ছাড়ের প্রচার যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ১০ শতাংশ ছাড়ও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই গ্রুপ টিকিটের ব্যবস্থা করা কিংবা করপোরেট সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে কোম্পানিগুলোর স্পনসরশিপ দেওয়া দরকার।

অন্যদিকে টেমাসেক পলিটেকনিকের ব্যবসা অনুষদের প্রভাষক বেঞ্জামিন কাসিম মনে করেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এখানে টিকিটের দাম যৌক্তিক। তবে স্থানীয়দের নিয়মিত আগমন নিশ্চিত করা হলে স্থায়ী আয়ের উৎস তৈরি হবে।
সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও বিনামূল্যে আয়োজন
স্থানীয় আকর্ষণগুলো কম আয়ের পরিবার ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখছে।
- • Gardens by the Bay বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করে বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার দিয়েছে, যাতে এখন পর্যন্ত ২.৮ লাখ মানুষ উপকৃত হয়েছেন।
- • Mount Faber প্রতি বছর প্রায় ১,৩০০ মানুষকে, বিশেষ করে শ্রমিক, প্রবীণ ও নিম্নআয়ের পরিবারকে বিনামূল্যে ক্যাবল কার রাইড করায়।
- • Marina Bay Sands-এর ‘Spectra’ শো এবং Gardens by the Bay-এর ‘Borealis’ বিনামূল্যের প্রদর্শনী, যা স্থানীয় ও বিদেশি সবার জন্য উন্মুক্ত।
স্থানীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি
STB-এর ২০২৫ সালের জরিপে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুরবাসীর বড় অংশ মনে করেন পর্যটন দেশের জীবনমান উন্নত করছে। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন বলেছেন, পর্যটনকেন্দ্রগুলো জীবনকে সমৃদ্ধ করছে, আর ৮ জন বিশ্বাস করেন, এগুলো সিঙ্গাপুরকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















