প্রতিবছর কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী আমাদের মনে করিয়ে দেয় এক অনন্য কণ্ঠস্বরের কথা, যে কণ্ঠস্বর একসময় নাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলার অন্তরাত্মা ও উপমহাদেশের মানুষকে। বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাত নজরুলের জীবন ও সাহিত্য ছিল অন্যায়, অবিচার ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে এক অগ্নিময় ঘোষণা। ১৯৭৬ সালে তাঁর প্রয়াণ ঘটলেও তাঁর কবিতা, গান ও ভাবনা আজও সমান শক্তিশালী—আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়: আমরা কি সত্যিই তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি?
বিদ্রোহের কবি
নজরুলের কবিতা কখনোই কেবল অলঙ্কার বা ব্যক্তিগত প্রেমের সীমায় আবদ্ধ ছিল না। ব্রিটিশ শাসনের অন্ধকার সময়ে তিনি কলম ধরেছিলেন প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে। তাঁর বিদ্রোহী বা ধূমকেতু-এর মতো রচনাগুলো কেবল সাহিত্য নয়, স্বাধীনতার মন্ত্র হয়ে উঠেছিল। শোষণ, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা—যে কোনো রূপে অত্যাচারকে তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাই নজরুল শুধু কবিই নন, ছিলেন মুক্তিকামী এক বিপ্লবী।

মানবতার কবি
কিন্তু নজরুলকে কেবল রাজনীতির কবি ভাবলে ভুল হবে। তিনি ছিলেন মানবতার কবি। হিন্দু-মুসলমানের ভেদরেখা ভেঙে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এক সাম্যের সমাজ। তাঁর গানে কখনো ভেসে আসে কোরআনের আয়াত, কখনো গীতার শ্লোক। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষকে বিভক্ত করা যায় না ধর্মের নামে, বর্ণের নামে কিংবা শ্রেণির নামে। বিভাজনের বিষে আজও যখন সমাজ আক্রান্ত, নজরুলের এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের পথ দেখায়।
নীরবতার বেদনা
জীবনের শেষভাগে নজরুল অসুস্থতার কারণে হারিয়ে ফেলেন বাকশক্তি। দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন নীরব—যে কণ্ঠস্বর একসময় সাম্রাজ্যের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তা স্তব্ধ হয়ে যায়। এই নীরবতা ছিল এক গভীর বেদনার প্রতীক। কিন্তু তাঁর কবিতা ও গান নিভে যায়নি। বরং তাঁর সৃষ্টি সময়ের সীমা পেরিয়ে আজও অনুপ্রেরণা জোগায়।

আজকের প্রাসঙ্গিকতা
প্রশ্ন হলো, আমরা কি সত্যিই নজরুলকে ধারণ করেছি? বৈষম্য, শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা ও অবিচার আজও সমাজে বিরাজমান। নজরুল যে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছিলেন, আজও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। তাঁর কণ্ঠ আমাদের আহ্বান জানায়—শুধু স্মৃতিচারণ নয়, সক্রিয় প্রতিরোধ ও ন্যায়ের সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য।
সত্যিকারের শ্রদ্ধাঞ্জলি
নজরুল কেবল ইতিহাসের পাতায় বন্দি নন, তিনি এক জীবন্ত প্রতীক। তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো মানে শুধু অনুষ্ঠানে গান গাওয়া বা কবিতা আবৃত্তি নয়—বরং তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করা। একটি ন্যায়সঙ্গত, সাম্যের ও সম্প্রীতির সমাজ গড়ে তোলা ছাড়া বিদ্রোহী কবিকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব নয়।
আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে মাথা নত করে আমাদের মনে রাখা উচিত: কাজী নজরুল ইসলাম কেবল কবিতা লেখেননি—তিনি কবিতার মতো বেঁচেছেন, লড়েছেন এবং ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেছেন এক দীপ্ত আলোকশিখা। প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই আলোয় আমাদের পথ চলা আলোকিত করতে পেরেছি?
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















