ভারত ও জাপান বাণিজ্য, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি এবং জনগণের বিনিময়সহ নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে চলেছে। বিশেষ কৌশলগত এই অংশীদারিত্ব আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে এমন সময়ে, যখন একতরফা মার্কিন শুল্ক আরোপ নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে।
শুক্রবার টোকিওতে এক অর্থনৈতিক ফোরামে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, “জাপান একটি প্রযুক্তি শক্তিধর দেশ, আর ভারত প্রতিভার শক্তিধর দেশ।” তিনি দুই দিনের সফরে জাপান এসেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের আগে এই মন্তব্য করেন। বৈঠকে বহু সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে।
মোদী, যিনি সর্বশেষ ২০২৩ সালে হিরোশিমায় জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে জাপান সফর করেছিলেন, এবার তার প্রধান কর্মসূচি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগকে শক্তিশালী সমর্থন দেওয়া। তিনি শিল্পখাতের নেতাদের আহ্বান জানান পাঁচটি বিশেষ ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে: উৎপাদন, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, সবুজ জ্বালানি, পরবর্তী প্রজন্মের অবকাঠামো, এবং দক্ষতা উন্নয়ন।
তিনি বলেন, “অটোমোবাইল খাতে আমাদের অংশীদারিত্ব অত্যন্ত সফল। আমরা একসঙ্গে ব্যাটারি, রোবোটিক্স, সেমিকন্ডাক্টর, জাহাজ নির্মাণ এবং পারমাণবিক শক্তিতেও একই ধরনের সাফল্য অর্জন করতে পারি।” তিনি আরও বলেন, টোকিও ও নয়াদিল্লি গ্লোবাল সাউথ, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোর উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারে।
মোদীর ভাষায়, “জাপানি ব্যবসার জন্য গ্লোবাল সাউথে প্রবেশের সোপান হলো ভারত। একসঙ্গে আমরা এশীয় শতাব্দীকে স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির পথে গড়ে তুলব।” তিনি জাপানি কোম্পানিগুলোকে ভারতের বৃহৎ, দক্ষ এবং তরুণ শ্রমশক্তিকে কাজে লাগাতে আহ্বান জানান।

ইশিবা ফোরামে বলেন, তিনি সম্পর্ককে আরও প্রসারিত করতে চান জনগণের পারস্পরিক বিনিময়, বায়োফুয়েলসহ নতুন শিল্প সহযোগিতা উদ্যোগ এবং সেমিকন্ডাক্টরের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিতে। তার মতে, ভারতের বিস্তৃত বাজারকে কাজে লাগিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক “অসাধারণ অগ্রগতি” করছে। নির্ভরযোগ্য অংশীদারের সঙ্গে স্থিতিশীল সাপ্লাই চেইন গড়ে তোলা এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন “অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।”
শুক্রবার পরবর্তী সময়ে দুই নেতা এক যৌথ দৃষ্টি নথি প্রকাশ করতে যাচ্ছেন, যেখানে আগামী দশকে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে একাধিক পদক্ষেপ ও অঙ্গীকার নির্ধারণ করা হবে।
এতে আটটি অগ্রাধিকার সহযোগিতা ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত থাকবে: অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, গতিশীলতা, পরিবেশ, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, স্বাস্থ্যসেবা, রাজ্য-প্রদেশ সহযোগিতা এবং জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগ।
জাপান আগামী দশকে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ দ্বিগুণ করে ১০ ট্রিলিয়ন ইয়েন (৬৮ বিলিয়ন ডলার) করার পরিকল্পনা করছে এবং আগামী পাঁচ বছরে ভারত-জাপান মানব বিনিময় বাড়িয়ে পাঁচ লাখে উন্নীত করবে।
উভয় দেশ একটি নতুন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সহযোগিতা উদ্যোগ শুরু করবে, যাতে সেমিকন্ডাক্টর, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি এবং ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো মূল ক্ষেত্রে সরবরাহ চেইন বৈচিত্র্য ও সুরক্ষিত করার উপায় খোঁজা হবে। এজন্য খনিজ সম্পদ নিয়ে সহযোগিতা স্মারক এবং উভয় দেশের মহাকাশ সংস্থার মধ্যে যৌথ চন্দ্র মেরু অনুসন্ধান মিশনের বাস্তবায়ন চুক্তিসহ একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরের কথা।
মোদীর জাপান সফর এমন সময়ে হচ্ছে যখন নয়াদিল্লি যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের ধাক্কা সামলাচ্ছে। বুধবার কার্যকর হওয়া এই শুল্ক ভারতে উৎপাদিত পণ্যে ৫০% হারে বসানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যে ২৫% শাস্তিমূলক শুল্ক, বিশেষ করে রাশিয়ার তেল ও অস্ত্র কেনাকাটায়, যা ওয়াশিংটনের মতে ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোর তহবিলের মূল উৎস।
এই শুল্ক নয়াদিল্লিতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে, কারণ এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার।
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সেবাস্টিয়ান মাসলো বলেন, “মোদীর সফর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান শুল্ক বিরোধের প্রেক্ষাপটে উভয় দেশের অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতা বাড়ানোর সুযোগ দিচ্ছে।”
ভারতের জন্য জাপানি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্প্রসারণ ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এজেন্ডা এগিয়ে নিতে অপরিহার্য। অন্যদিকে জাপানের জন্য ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার, বিশেষত যখন টোকিও ওয়াশিংটনের সঙ্গে চলমান দ্বন্দ্বের মাঝে তার বাণিজ্য ও উৎপাদন নেটওয়ার্ককে বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টা করছে।

ভারতের বিরল খনিজ সম্পদের মজুত ও জাপানের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণে এই সহযোগিতা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। মাসলোর মতে, “এই সহযোগিতা জাপানের বৃহত্তর কৌশলের অংশ, যার মধ্যে রয়েছে ‘ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ইন্দো-প্যাসিফিক’ ভিশনের আওতায় উচ্চমানের অবকাঠামো সরবরাহ এবং গুরুত্বপূর্ণ খাতে সরবরাহ চেইনের স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করা।”
২০০৮ সালের যৌথ নিরাপত্তা ঘোষণাকে হালনাগাদ করারও প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই দেশ, যাতে বর্তমান অগ্রাধিকারের প্রতিফলন ঘটে এবং নতুন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের জবাব দেওয়া যায়। এতে মহাকাশ ও সাইবার নিরাপত্তায় সহযোগিতা বিস্তৃত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা শিল্প সহযোগিতাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
ভারত ও জাপান ‘কোয়াড’ নিরাপত্তা কাঠামোরও অংশীদার, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া রয়েছে। মোদী ও ইশিবা এই শীর্ষ বৈঠকে এ কাঠামো আরও শক্তিশালী করার উপায় খুঁজবেন, বিশেষত যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্রি সম্প্রতি বলেন, জাপানের সঙ্গে নতুন পদক্ষেপগুলো “সম্পর্কে স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে এবং নতুন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার” উদ্দেশ্যে নেওয়া হচ্ছে।
শনিবার ইশিবা ও মোদী মিয়াগি প্রিফেকচারের সেনদাই শহরে টোকিও ইলেকট্রনের কারখানা পরিদর্শন করবেন, যা সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন সরঞ্জামের বড় নির্মাতা।
জাপান সফর শেষে মোদী সাত বছরের মধ্যে প্রথমবার চীন সফরে যাবেন। তিনি তিয়ানজিনে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে যোগ দেবেন।
রবিবার ও সোমবার তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ অন্যান্য নেতার সঙ্গে বৈঠক করবেন।
চীন সফরও গুরুত্বপূর্ণ হবে, কারণ ২০২০ সালের প্রাণঘাতী সীমান্ত সংঘর্ষের পর দুই দেশ উত্তেজনা প্রশমনে চেষ্টা করছে। পাঁচ বছর পর তারা সরাসরি বিমান চলাচল পুনরায় শুরু করার পরিকল্পনা করছে এবং বাণিজ্য বাধা দূর করার বিষয়ে আলোচনা করছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যদিও চীন-ভারত সম্পর্ক কিছুটা উন্নতির লক্ষণ দেখাচ্ছে যা ওয়াশিংটনের বিপরীতে উভয় দেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে, তবুও এখনই বড় ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা বলার সময় নয়।
মাসলো বলেন, “বাস্তবতা হলো ভারত ও চীন এখনো সমাধানহীন দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনার মুখোমুখি। পাশাপাশি ব্রিকস জোট এবং গ্লোবাল সাউথে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে প্রকৃত কৌশলগত ঐক্য নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব নয়।”
গ্যাব্রিয়েল ডোমিঙ্গেজ 



















