বাংলাদেশ, যা মধ্যপ্রাচ্যের রেমিট্যান্সের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, ধীরে ধীরে সেখানকার অবস্থান হারাচ্ছে। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসা এবং সামনে বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
২০২৪ সালে হাসিনা সরকারের পতনের পর রেমিট্যান্স প্রবাহ রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রবণতা বলছে, বিশেষত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান এবং বাহরাইন থেকে রেমিট্যান্স কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, আগস্টে রেমিট্যান্স দাঁড়ায় ২.৪২ বিলিয়ন ডলার, যা জুলাইয়ে ছিল ২.৪৭ বিলিয়ন ডলার এবং জুনে ২.৮২ বিলিয়ন ডলার।
বছওয়ারি হিসাবে এখনো প্রবৃদ্ধি রয়েছে, কিন্তু সাম্প্রতিক নিম্নমুখী ধারা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থির বাজারই মূল চালক।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক মাহফুজ কবির বলেন, “বাংলাদেশের শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যে সংকুচিত হচ্ছে। এসব দেশ এখন ক্রমেই ভারত ও নেপাল থেকে দক্ষ শ্রমিক নিচ্ছে। তার ওপর ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং কাতারে সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার প্রভাবও পড়েছে। এসব আঞ্চলিক অস্থিরতা সরাসরি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।”

সৌদি আরব এখনো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেমিট্যান্স উৎস, যেখানে প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত।
২০২৪ সালেই সেখানে ৬ লাখ ২৮ হাজারের বেশি কর্মী গেছেন (বিএমইটি তথ্য অনুসারে)। কিন্তু সংখ্যা বেশি হলেও সুযোগ কমছে, ফলে অনেক প্রবাসী কষ্টে টিকে থেকে সামান্য অর্থ পাঠাতে পারছেন।
প্রতিবছর হাজার হাজার শ্রমিক স্থায়ী কাজ না পেয়ে সৌদি আরব থেকে ফিরে আসেন। ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের তথ্যে, ২০২৪ সালে ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক “আউটপাস” প্রক্রিয়ায় দেশে ফেরেন, যা ২০২৩ সালে ছিল ৫৮ হাজার।
অনেক শ্রমিক বিপুল টাকা খরচ করেও চাকরি পান না। মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর বৈধ কর্মসংস্থান বা ‘আকামা’ ছাড়াই টিকে থাকতে হয়।
ঝালকাঠির এবায়দুল ইসলাম গত বছর সৌদি আরব থেকে ফিরে এসে বলেন, “আমাকে তিন মাসের মধ্যে আকামা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এক বছর পরও পাইনি। প্রতিশ্রুত চাকরিও পাইনি। অবৈধভাবে প্রতিদিন লুকিয়ে থাকতে হয়েছে।”
আরেক প্রত্যাবর্তনকারী মিরাজুল হাওলাদার বলেন, “বাংলাদেশিদের জন্য আকামা এখন সোনার হরিণের মতো। যদি পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতেই না পারি, তবে বিদেশে থেকে লাভ কী?”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স পতনও দেখাচ্ছে। মে মাসে ৬,৫২৪ কোটি টাকা এলেও জুনে তা নেমে আসে ৫,৭৬৩ কোটিতে, জুলাইয়ে ৫,২০০ কোটিতে এবং আগস্টে আরও কমে দাঁড়ায় ৪,৮০০ কোটিতে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) পরিচালক মারিনা সুলতানা বলেন, “সৌদি আরব নতুন দক্ষতা মানদণ্ড দিয়ে শ্রমবাজার পুনর্গঠন করছে। এসব পূরণ না করতে পারলে কাজ বা আকামা পাওয়া কঠিন হবে। বাংলাদেশকে দক্ষতা উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অদক্ষ শ্রমিক পাঠানো চলতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি বাড়বে।”

সংযুক্ত আরব আমিরাতও (ইউএই) বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে, ২০২৬ সাল থেকে দেশটি বাংলাদেশিদের কাজের ভিসা দেওয়া বন্ধ করতে পারে। ইতিমধ্যেই ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা চলছে। ভিসা ট্রান্সফার ও পরিবার ভিসার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
২০২৫ সালের মার্চে ইউএই থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৬,২০১ কোটি টাকা, কিন্তু এপ্রিলেই তা নেমে আসে ৪,৫৪০ কোটিতে। জুলাইয়ে দাঁড়ায় ৩,৪৬১ কোটি এবং আগস্টে আরও কমে ৩,৩৮২ কোটিতে। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, ভিসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ হঠাৎ ভেঙে পড়তে পারে।
মাহফুজ কবির বলেন, “সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। ঢাকাকে দ্রুত আবুধাবির সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনায় বসতে হবে। ইউএই বাজার হারালে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থান মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে।”
কাতার থেকেও প্রবাহ কমেছে। জুনে যেখানে রেমিট্যান্স ছিল ১,৪৩২ কোটি টাকা, জুলাইয়ে তা নেমে আসে ১,২৮৮ কোটিতে এবং আগস্টে আরও কমে দাঁড়ায় ১,১১৩ কোটিতে।
ওমান ২০২৩ সালেই বাংলাদেশি কর্মীদের নিষিদ্ধ করেছে। এ বছর জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স সাময়িকভাবে ২,০০০ কোটির ওপরে গেলেও জুন থেকে পতন শুরু হয়ে আগস্টে এসে দাঁড়ায় প্রায় ১,৭০০ কোটিতে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে বাংলাদেশ আরও গভীর সংকটে পড়তে পারে।
মাহফুজ কবির মন্তব্য করেন, “আঞ্চলিক অস্থিরতা থাকলেও সরকারকে এখনই বাজার রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে হবে।”
মারিনা সুলতানা যোগ করেন, “শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এত প্রবাসী কেন স্থায়ী কাজ পাচ্ছেন না, তা খুঁজে বের করতে হবে। যারা বিদেশে আছেন, তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বিশেষ কর্মসূচিও দরকার।”
ইউএনবি থেকে অনূদিত 



















