মস্কোর আদালতে সাজা
১৯৬০ সালের ১৯ আগস্ট, আজ থেকে ৬৫ বছর আগে, মস্কোর আদালত মার্কিন পাইলট ফ্রান্সিস গ্যারি পাওয়ার্সকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়। সোভিয়েত নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর তিনি গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত হন। এই ঘটনা ঠান্ডা যুদ্ধের এক ভয়াবহ কূটনৈতিক সংকট ডেকে আনে।
মিসাইল হামলায় ভূপাতিত
সিআইএর গোপন মিশনে থাকা অবস্থায় পাওয়ার্সের ইউ-২ গোয়েন্দা বিমানকে সোভিয়েতরা মাটিভিত্তিক মিসাইল দিয়ে আঘাত করে। তিনি পরে স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, আকাশজুড়ে কেবল কমলা রঙের আগুনের ঝলকানি দেখা যাচ্ছিল। তখনই তিনি ভেবেছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্ত এসে গেছে।
যদিও তিনি প্যারাশুটে নেমে বেঁচে যান, কিন্তু কেজিবির হাতে ধরা পড়েন। পরিবারের চোখের সামনে মস্কোতে তাঁর বিচার হয়। স্ত্রী বারবারা পাওয়ার্স বলেছিলেন, স্বামী তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়েও কষ্টে তাঁদের দিকে তাকাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ৩ বছর কারাভোগ ও ৭ বছর শ্রমশিবির মিলিয়ে ১০ বছরের সাজা দেওয়া হয়।

একজন কয়লাখনি শ্রমিকের ছেলে থেকে সিআইএ গুপ্তচর
কেন্টাকির কয়লাখনি শ্রমিকের ছেলে পাওয়ার্স পড়াশোনায় ছিলেন বিজ্ঞানপ্রীতি। ১৯৫০ সালে মার্কিন বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে সিআইএ তাঁকে ইউ-২ বিমানের পাইলট হিসেবে নিয়োগ করে। এসব বিমান ৭০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ে সোভিয়েত ঘাঁটির সূক্ষ্ম ছবি তুলতে পারত।
১৯৬০ সালের ১ মে পাকিস্তানের পেশোয়ার থেকে উড্ডয়ন করে তাঁকে নরওয়ে পর্যন্ত উড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই রুটে সোভিয়েতের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাগুলোর ছবি তোলা ছিল লক্ষ্য।
ভূপাতিত হওয়ার মুহূর্ত
সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই সতর্ক ছিল। মিগ-১৯ জেট ও এস-৭৫ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তাঁকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। চার ঘণ্টা পর বিমানে আঘাত লাগে এবং ডানার একটি অংশ ছিঁড়ে যায়। বিমানটি লেজ দিক আগে ঘুরে মাটির দিকে নামতে থাকে।
তাঁর ছেলে গ্যারি পাওয়ার্স জুনিয়র জানিয়েছেন, বাবা ইজেকশন সিট ব্যবহার না করে ককপিটের ছাদ খুলে বের হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এতে তিনি আধা-আধি বাইরে বেরিয়ে যান, অক্সিজেন নলের সঙ্গে ঝুলে থেকে আঘাত পেতে পেতে নিচে নামতে থাকেন। অবশেষে বিমান থেকে আলাদা হয়ে প্যারাশুটে নেমে বাঁচেন।
ধরা পড়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংকট
সভার্দলোভস্ক অঞ্চলে নামার সঙ্গে সঙ্গেই একটি কালো গাড়িতে তাঁকে নজরে আনা হয়। কেজিবি দ্রুত তাঁকে গ্রেপ্তার করে, বিমান ও ক্যামেরার ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে দাবি করে, এটি নাসার আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ বিমান, যা ভুলক্রমে সোভিয়েত আকাশে ঢুকে পড়েছিল। এমনকি নাসার লোগো দেওয়া ছবি পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়। কিন্তু খ্রুশ্চেভ ঘোষণা করেন, পাওয়ার্স জীবিত ও তাঁর ক্যামেরা অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এতে মার্কিন প্রশাসনকে মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হতে হয়।
এই কেলেঙ্কারি ঘটে ঠিক সেই সময়, যখন প্যারিসে যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। খ্রুশ্চেভ ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার অস্বীকার করেন। ফলাফল—আশানুরূপ শান্তি আলোচনাই ভেস্তে যায়।
বিচার ও তীব্র সমালোচনা
মস্কোতে বিচার চলাকালীন অনেক পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম তাঁকে ভীরু, অদক্ষ এবং অতি সরল বলে বর্ণনা করে। মার্কিন ও ব্রিটিশ সংবাদপত্রে এমন সম্পাদকীয়ও প্রকাশিত হয় যে, পাওয়ার্স হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

তবে ১৯৬২ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়, এটি ছিল মানবিকতা থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত। বাস্তবে তিনি সোভিয়েত গুপ্তচর রুডলফ অ্যাবেল-এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরেন। এই বিনিময়ের ওপর ভিত্তি করে পরে স্টিভেন স্পিলবার্গ চলচ্চিত্র ব্রিজ অব স্পাইজ নির্মাণ করেন।
মুক্তির পর জীবন
মুক্তির পরও তাঁকে মার্কিন জনমতের সন্দেহের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু সেনেটের শুনানিতে তাঁকে সাহসী হিসেবে প্রশংসা করা হয় এবং ১৯৬৫ সালে সিআইএ তাঁকে ইন্টেলিজেন্স স্টার পদক দেয়।
পরে তিনি লকহিডে টেস্ট পাইলট ও পরে লস অ্যাঞ্জেলসের এক টিভি চ্যানেলে হেলিকপ্টার পাইলট হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৭ সালে এক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।
উত্তরাধিকার
তাঁর ছেলে গ্যারি পাওয়ার্স জুনিয়র ছোটবেলায় বাবার মিশনের বিস্তারিত জানতেন না। বড় হয়ে নিজেই অনুসন্ধান শুরু করেন এবং ১৯৯৬ সালে ভার্জিনিয়ায় কোল্ড ওয়ার মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই জানতাম বাবা সোভিয়েতদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন এবং গুপ্তচর বিনিময়ে মুক্তি পান। কিন্তু তখন সেটাই আমার কাছে স্বাভাবিক ছিল।
এই ঘটনা ঠান্ডা যুদ্ধের ইতিহাসে এক অমোচনীয় অধ্যায় হিসেবে থেকে গেছে—যেখানে এক বিমানের পতন বৈশ্বিক রাজনীতিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















