“পঞ্চান্ন বছর ধরে পট আঁকছি। স্বামীর হেল্পার হিসাবে কাজ শুরু করেছিলাম।”
কথাগুলাে বলছিলেন কৃষ্ণনগরের শিল্পী রেবা পাল। আশি ছুঁইছুঁই বয়সেও রােজ আঁকেন তিনি।
“উনি (স্বামী) মৃত্যু শয্যায় বলে গিয়েছিলেন, এবার তোমাকে একাই হাল ধরতে হবে। তারপর থেকে একাই আঁকছি।”
সাবেকী দুর্গাপুজোর সঙ্গে চালচিত্রের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। দুর্গাপ্রতিমা সংলগ্ন অর্ধগোলাকৃতির পটচিত্রই হলো চালচিত্র। এর উপর পটশিল্পী বা পটুয়ারা হিন্দু দেব-দেবীর আখ্যান তুলে ধরেন।
কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোজ সরকার ব্যাখ্যা করেছেন, “চালচিত্র বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা। এর জন্ম বাংলার মাটি থেকে। একেবারে দেশজ সামগ্রী দিয়ে তৈরি হয়। দুর্গা ঠাকুরের চালে বিভিন্ন দেব-দেবীর কাহিনী বর্ণনা করা হয়।”
“শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে গেলে চালচিত্র পুরো কাঠামোটাকে যেন বেঁধে রেখেছে। চালচিত্র সরিয়ে দিলে কিন্তু ওই বাঁধনটা আর থাকবে না।”
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ‘বাঁধন’ তৈরির কাজ করছেন রেবা পাল। তার আঁকা চালচিত্রের সুনাম রয়েছে।
এক সময় অভাবের তাড়নাতে স্বামীকে সাহায্য করতে গিয়েই তিনি এ কাজ শুরু করেছিলেন। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে চার সন্তানকে বড়ও করেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর গত কুড়ি বছরে অনেক কিছু বদলেছে কিন্তু এই কাজ ছাড়েননি তিনি।
এ দুই দশকে কাজের স্বীকৃতি যেমন তিনি পেয়েছেন, তেমনি পেয়েছেন সম্মান। চলতি বছর কলকাতার নিউটাউন সিএ ব্লকের দুর্গাপুজো মণ্ডপ সাজানাে হয়েছে তার শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণায়।

‘উনিই আমাদের অনুপ্রেরণা’
কলকাতার নিউটাউন সিএ ব্লকের পুজোর মণ্ডপ সজ্জা এবং প্রতিমা যে শিল্পীর হাত ধরে, তার নাম প্রবীর সাহা।
তার কথায়, “কাজ করতে গিয়ে আমরা প্রতিমার প্যাটার্ন বদলেছি, ভাবনা বদলেছি কিন্তু পটে আঁকার বিষয়টা আমাকে বরাবর আকর্ষণ করেছে। আমার মনে হয়েছে যারা এই পট তৈরি করছেন, চালের উপর দেব-দেবীর ছবি আঁকেন তাদের কথাও বলা দরকার।”
সে ভাবনা থেকেই নিউটাউনের এই দুর্গা পুজোর মণ্ডপ সেজে উঠেছে চালচিত্রে। মণ্ডপে ঢুকতেই রাখা হয়েছে প্রবীর সাহার আঁকা রেবা পালের প্রতিকৃতি।
মি. সাহা বলেছেন, এই মণ্ডপের পটচিত্রগুলো চালচিত্রের আকারে তৈরি। পটচিত্রে সাধারণত মঙ্গলকাব্য বা বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাখ্যান ফুটে ওঠে।
“লোকসংস্কৃতির এক অপূর্ব নিদর্শন পটচিত্র।”
শিল্পী মনোজ সরকারের কথায়, “পটচিত্র কিন্তু চালচিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে চালচিত্র যেমন দুর্গাকে কেন্দ্র করে তৈরি, পটচিত্র কিন্তু নানা রূপ নিয়েছে। দেব দেবীদের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন কথা তুলে ধরার জন্য এর ব্যবহার দেখা গিয়েছে।”
এরই নিদর্শন মিলবে নিউটাউনের এই দুর্গাপুজোয়। মণ্ডপের দুর্গা প্রতিমাতেও রয়েছে এই লোকশিল্পের প্রতিফলন।

পটচিত্র দেখতে কেমন তা ব্যাখ্যা করেছেন প্রবীর সাহা।
তিনি বলেছেন, “স্ক্রোলের মতো দেখতে এই পটচিত্র। একটু একটু করে সেই স্ক্রোল খুলে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয় পটচিত্রে আঁকা গল্প। সঙ্গে গান থাকে বা কবিতার আকারে ওই ছবির দৃশ্য বর্ণনা করা হয়। মণ্ডপের দুর্গা প্রতিমাও সে কথা মাথায় রেখে তৈরি।”
“এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বাংলায় যারা এই পটচিত্র আঁকেন, তাদের একটা বড় অংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ।”
নিউটাউনের এই পুজো মণ্ডপে পটচিত্র এঁকেছেন হামিদ চিত্রকর। তিনি জানিয়েছেন, রেবা পালের শিল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই মণ্ডপে পট আঁকতে একমাসেরও বেশি সময় লেগেছে।
হামিদ চিত্রকররা বংশপরম্পরায় পটচিত্র শিল্পী।
তিনি বলেন, “আমার বাবা-ঠাকুরদা পটচিত্র শিল্পী ছিলেন। স্কুলে যাওয়ার সময় দেখতাম তারা বাড়ির দাওয়ায় বসে আঁকছেন। ফিরে এসে যদি দেখতাম তারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমচ্ছেন, আমি রঙ-তুলি নিয়ে বসে পড়তাম। তারপর মা এসে বকতেন। ওইভাবেই কাজ শিখেছি।”
দুর্গা পুজোর কাজ করতে করতেই কথাগুলো বলছিলেন তিনি। দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে মণ্ডপে সেই সময় চূড়ান্ত ব্যস্ততা, দম ফেলার ফুরসত নেই।

পট এঁকেই দিন কাটে রেবা পালের
কলকাতার ব্যস্ততা, পুজোর জাঁকজমক থেকে বহু দূরে কৃষ্ণনগরে বাস করেন এই শিল্পী। যে সময় তার বাড়িতে বিবিসির সংবাদকর্মীরা হাজির হন, তখন ভরা দুপুর।
তার শিল্পকর্ম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিউটাউনে এবারের দুর্গাপুজো হচ্ছে সেটা শুনে একগাল হাসেন রেবা পাল।
তারপর বলেন, “আমার কাজকে সবাই ভালবাসছে দেখে ভাল লাগে। মাঝেসাঝে পুজো উদ্বোধনের জন্য নিয়ে যায় কলকাতায়। গত বছর কালীঘাটের পুজোতে নিয়ে গিয়েছিল। খুব ভাল লেগেছিল।”
নিউটাউনের পুজো মণ্ডপে ব্যস্ততা থাকলেও তার বাড়ির দাওয়া যেন ‘অতি সন্তর্পণে’ সেই ব্যস্ততার ছোঁয়াচ এড়িয়েছে।
অথচ এক সময়, পুজোর আগ দিয়ে এই বাড়িতেই চূড়ান্ত ব্যস্ততা থাকত।
স্বামী সন্তোষ পালও তার কাজের জন্য পরিচিত ছিলেন। ধীরে ধীরে স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে রেবা পালও এই কাজ শুরু করেন।
“১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। দুই-তিন বছর পর থেকেই তার কাজে হেল্প করতাম। যাতে বেশি কাজ করতে পারি। খুব অভাব ছিল,” বলছিলেন এই প্রবীণ শিল্পী।
বলছিলেন, স্বামীর কাছ থেকে আঁকা শিখেছেন। তারপর ধীরে ধীরে রপ্ত করেছেন এই শিল্প।

“আমার স্বামী নিজেই কলকাতায় তার হাতের তৈরি কাজ বিক্রির জন্য নিয়ে যেতেন। উনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আমিই যেতাম। এখন পট এঁকে দিন কাটে,” বলেছেন তিনি।
স্বামীকে হারানোর পর কুড়ি বছরেরও বেশি সময় বয়ে গিয়েছে।
টালির চাল দেওয়া তার বাড়ির দাওয়ায় বসেই কাজ করেন তিনি।
দাওয়ার এক কোণে রাখা ঘরের সামগ্রী, অন্য কোণে রঙের ছোট ছোট কৌটো। নিজেই বাজার থেকে শুকনো রঙ কিনে আনেন তিনি। তার সঙ্গে বাড়িতে তৈরি আঠা, ভেষজ উপাদান মিশিয়ে রঙ তৈরি করে আঁকেন।
কাগজ ছিঁড়ে বাড়িতে তৈরি আঠা, খড়িমাটি দিয়ে বানানো হয় পট।
তারপর সেখানে আঁকা হয় বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবীর উপাখ্যান – যার কোনোটায় দেবী দুর্গা অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, কোথাও দুর্গার কোলে রয়েছে গণেশ।
রেবা পালের কথায়, “আগে পুজোর জন্য বড় বড় চালির অর্ডার আসত। তাছাড়া বড় পটে আঁকার কাজও করতাম। এখন আর তেমন চাহিদা নেই।”
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টি শক্তি কমেছে, টানা কাজ করতে কষ্ট হয়। কিন্তু শিল্পের সঙ্গে তার একাত্মতা কমেনি।
তিনি বলেছেন, “অনেক বয়স হয়েছে, শরীরে দেয় না। সারা বছর দিনে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা কাজ করি।”
দিন শুরু হয় ভোর সাড়ে চারটেয়। স্নান সেরে ফুল তুলে পুজো করার পর কাজ শুরু করেন তিনি।
আশি ছুঁই ছুঁই এই শিল্পী জানিয়েছেন মেয়েরা কেনাকাটা করে দিলেও নিজেই বাজারে গিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পছন্দ করেন তিনি – তা সে রঙ, তুলি হোক বা সব্জি। তারপর বাড়ি ফিরে নিজেই রান্না করেন।
হেসে বলেন, “একলা মানুষ, এতটা সময় কী করব? নিজেই সবকিছু করি। যত দিন শরীরে কুলোবে আমিই করব।”

‘এই শিল্প আর বাঁচবে না’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্গাপুজোয় ফ্লেক্সের ব্যবহার বেড়েছে। ডিজিটাল প্রিন্টিংয়ের প্রচলনের পর সাবেকী শিল্পের উপর তার প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন শিল্পীরা।
তাই আক্ষেপের সুরে হামিদ চিত্রকর বলেন, “আজকাল কেউ এই কাজ করতে চায় না। আস্তে আস্তে চাহিদা কমেছে। ছেলেরাও অন্য কাজ খুঁজছে।”
সে ভাবনা থেকেও নিউটাউন সিএ ব্লকের সর্বজনীন দুর্গাপুজোর এই উদ্যোগ। অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সুভাষ ভট্টাচার্য বিবিসিকে বলেছেন, “আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। সাধারণ মানুষের কাছে এর মহিমা তুলে ধরার জন্যই আমাদের উদ্যোগ।”
শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান রেবা পালও।
তার শ্বশুর এবং স্বামী বংশপরম্পরায় এই পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন। তারপর ভালবেসে এই কাজ করছেন রেবা পাল।
তার কথায়, “এক সময় এই পাড়ার অনেক বাড়িতেই পট আঁকা হতো। তাদের অনেকেই আর কাজ করে না। আমার ছেলেও বাইরে কাজ করে, পুজোর কাজই, কিন্তু পট আঁকে না। এতে রোজগার হয় না।”
“আসলে আগে পটের দাম কম ছিল, কিন্তু কদর ছিল বেশি। আগে যে পট কুড়ি টাকায় বিক্রি হতো সেটা ২০০টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু হাতে আঁকা কাজের কদর।”

বার্ধক্য ভাতা বাবদ এক হাজার টাকা এবং আঁকা বিক্রি করে সামান্য আয়ের উপরেই দাঁড়িয়ে চলে এই প্রবীণ শিল্পীর সংসার। বাড়িতে অভাবের ছাপ স্পষ্ট।
কিন্তু সে সব নিয়ে একেবারেই ভাবিত নন তিনি।
“খুব একটা বেচাকেনা হয় না। তবে আর কতদিনই বা বাঁচব। তিন মেয়ে, এক ছেলে। তারা নিজেদের মতো সংসার করছে। মাথার উপর স্বামীর তৈরি বাড়ি আছে।”
নতুন প্রজন্ম যে এই শিল্পকে পেশা হিসাবে নেবে না, সে কথাও তার জানা। নাতি নাতনিদের কেউ লেখা পড়া করছেন, কেউ বা চাকরি।
এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনিও সন্দিহান।
তার কথায়, “কম্পিউটারের (ডিজিটাল প্রিন্টিংয়ের মতো উন্নত প্রযুক্তি বোঝাতে) জন্যই এই অবস্থা। ৫০ টাকায় যে প্রিন্ট কিনতে পাওয়া যায় সেটা আমার কাছ থেকে কেন লোকে বেশি দাম দিয়ে কিনবে?”
তবে এই শিল্প যে তিনি ধরে রাখবেন সে কথা জানিয়েছেন।
রেবা পালের কথায়, “আমি যতদিন বেঁচে থাকব, করব। আমার তো আর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। যা আয় হয় তা দিয়ে আমার চলে যায়। কিন্তু এই শিল্প আর বাঁচবে না… কিছুতেই বাঁচানো যাবে না। কিন্তু দুঃখ করে কী করব।”
আমাদের কথোপকথন শেষ হতে হতে বেলা অনেকটাই গড়িয়েছে।
সামনে রাখা চালচিত্র, রঙ তুলি গুছিয়ে রেখে ফিরে যান তার রোজনামচার পরবর্তী ধাপে। পরের দিনের অপেক্ষায় থাকেন। নিয়ম মেনে এই দাওয়াতে বসেই পরদিন আবার শুরু হবে তার পটে আঁকার কাজ।
BBC News বাংলা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















