লন্ডনে কেরি জেমস মার্শালের বড় প্রদর্শনী
লন্ডনের রয়্যাল একাডেমি অব আর্টসে শুরু হয়েছে মার্কিন শিল্পী কেরি জেমস মার্শালের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী “The Histories”। এখানে প্রদর্শিত বিশাল ক্যানভাস “School of Beauty, School of Culture” (২০১২) দর্শকদের সামনে শুধু এক সাধারণ হেয়ার সেলুনের দৃশ্যই নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার নানা সংকেতও হাজির করে। ৯ ফুট লম্বা ও ১৩ ফুট চওড়া এই চিত্রকর্ম এক দেওয়ালজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে, যা ৬০ মিটার দূর থেকেও দেখা যায়।
মার্শালকে আজ বিশ্বের অন্যতম সেরা জীবিত চিত্রশিল্পী ধরা হয়। ২০১৮ সালে তার আরেক কাজ “Past Times” নিলামে বিক্রি হয়েছিল ২১.১ মিলিয়ন ডলারে — যা সে সময় জীবিত কোনো আফ্রিকান-আমেরিকান শিল্পীর জন্য রেকর্ডমূল্য।
চিত্রকর্মের দৃশ্য ও লুকানো স্তর
“School of Beauty, School of Culture” এর কাহিনি মূলত এক ব্যস্ত হেয়ার সেলুনকে ঘিরে। কেউ চুল বাঁধছে, কেউ আলাপ করছে, আবার কেউ পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছেন ভঙ্গিমায়, আর তার পায়ের কাছে খেলা করছে দুই শিশু। এই দৃশ্যে একদিকে স্থানীয় ব্যবসার চাঞ্চল্য ধরা পড়েছে, অন্যদিকে কমিউনিটির সামাজিক মিলনকেন্দ্র হিসেবেও সেলুনকে দেখা গেছে।
তবে মার্শালের কাজ শুধু দৈনন্দিন জীবনের ছবি নয়। তিনি আর্ট হিস্টরির নানা রেফারেন্স এতে যুক্ত করেছেন — হলবাইন, রাফায়েল থেকে শুরু করে ডিজনির চরিত্র পর্যন্ত। ছবির ভেতরেই লুকিয়ে আছে নানা কোডেড সংকেত, যা দর্শককে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে।

কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয় ও সৌন্দর্যচর্চার স্থান
মার্শাল নিজে বলেন, তিনি সচেতনভাবে সৌন্দর্যচর্চার এই স্থানকে বেছে নিয়েছেন কারণ এটি কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিকাগোতে তার স্টুডিওর কাছেই রয়েছে এক বিউটি স্কুল, যেখানে কসমেটোলজি ও নখ পরিচর্যার ক্লাস চলে। তিনি মনে করেন, এই ধরনের সেলুন শুধু রূপচর্চার নয়, বরং রূপান্তরের স্থান — যেখানে মানুষ নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে বেরিয়ে আসে।
আগের কাজের সঙ্গে সংযোগ
এই ছবির সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত রয়েছে তার আগের কাজ “De Style” (১৯৯৩), যেখানে একটি কৃষ্ণাঙ্গ নরসুন্দরখানার ছবি আঁকা হয়েছে। নামটি নেওয়া হয়েছে ডাচ শিল্প আন্দোলন De Stijl থেকে। সেখানে যেমন রঙের প্রাধান্য, জ্যামিতিক বিন্যাস ও স্টাইলাইজড ভঙ্গি ছিল, তেমনই মার্শালের ছবিতে দেখা যায় প্রতীকী চুলের ধরন ও খ্রিস্টের ভঙ্গির মতো হাততোলা নরসুন্দর।

শিল্প ও সংস্কৃতির রেফারেন্স
চিত্রটিতে লুকানো রয়েছে ইউরোপীয় শিল্প ইতিহাসের স্পষ্ট রেফারেন্স। যেমন:
- ডিজনির Sleeping Beauty – এর বিকৃত প্রতিচ্ছবি, যা হ্যান্স হলবাইনের “The Ambassadors” (১৫৩৩)-এর অ্যানামরফিক খুলির প্রতি ইঙ্গিত।
- দেয়ালে লাগানো আয়না স্মরণ করিয়ে দেয় ভ্যান আইকের “Arnolfini Portrait” (১৪৩৪) ও ভেলাজকুয়েজের “Las Meninas” (১৬৫৬)।
- সেলুনের দেওয়ালে ঝোলানো লরিন হিলের পোস্টার ও ব্রিটিশ-জ্যামাইকান শিল্পী ক্রিস ওফিলির প্রদর্শনীর পোস্টার কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে।
কিউরেটর মার্ক গডফ্রে বলেন, মার্শাল পশ্চিমা শিল্পের ঐতিহ্যকে সম্মান করেন, তবে একই সঙ্গে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রকে বড় মাপে তুলে ধরে সেই ঐতিহ্যের সীমাবদ্ধতাকেও চ্যালেঞ্জ জানান।

কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রের গভীরতা
মার্শালের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার সব চরিত্রকে গভীর কালো রঙে আঁকা। তিনি বলেন, এগুলো কেবল বাহ্যিক কালো নয়, বরং মূল থেকে কৃষ্ণাঙ্গ। ১৯৮০ সালের “A Portrait of the Artist as a Shadow of His Former Self” – এ যেখানে চরিত্রকে একরঙা কালোতে দেখা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ত্বকের গভীরতায় আরও জটিলতা ও বৈচিত্র্য যোগ করেছেন। এখন তার চরিত্রগুলো পূর্ণমাত্রিক, বহুমাত্রিক উপস্থিতি তৈরি করে।
কেরি জেমস মার্শালের “School of Beauty, School of Culture” শুধু এক সেলুনের ছবি নয়। এটি একাধারে কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয়ের উদযাপন, পশ্চিমা শিল্প ইতিহাসের সমালোচনা ও আধুনিক কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা। এই কাজ দর্শককে মনে করিয়ে দেয় — শিল্প শুধু দৃশ্যমান সৌন্দর্য নয়, বরং সমাজ, ইতিহাস ও পরিচয়ের গভীর বার্তাও বহন করে।
প্রদর্শনী চলবে রয়্যাল একাডেমি, লন্ডনে ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















