বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাসে এক নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন কয়েকজন নায়িকা। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাহিয়া মাহি। ঢাকাই চলচ্চিত্রের অচলাবস্থা, দর্শক সংকট এবং বাণিজ্যিক ছবির দুরবস্থার সময় যে কজন শিল্পী নতুন আশার আলো নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, মাহি ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী। ২০১২ সালে অভিষেকের পর থেকে তিনি দ্রুতই দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নেন এবং হয়ে ওঠেন এক দশকেরও বেশি সময়ের আলোচিত নাম।
শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি
মাহি জন্মগ্রহণ করেন রাজশাহী জেলায়। পরিবারের স্নেহ-ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা এই কন্যার শৈশব কেটেছে সাধারণ পরিবেশে, তবে সাংস্কৃতিক আবহও ছিল প্রবল। তার বাবা-মা পড়াশোনায় জোর দিলেও মেয়ের শিল্প-সাহিত্য চর্চার বিষয়েও সহানুভূতিশীল ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই মাহি স্কুলের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, নাটক ও নাচে অংশ নিতেন। এগুলো তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে প্রবেশের সাহস যোগায়।
শিক্ষা ও তারুণ্যের পদক্ষেপ
রাজশাহীতেই মাহির প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। কলেজজীবনে এসে তিনি আরো সক্রিয় হয়ে ওঠেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। সেই সময়ের মডেলিং প্রতিযোগিতা, ফ্যাশন শো কিংবা স্থানীয় টিভি প্রোগ্রামে তিনি নিয়মিত অংশ নিতেন। তারুণ্যের শুরুতে তিনি উপলব্ধি করেন যে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোই তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। অভিনয় এবং শিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্রে অভিষেক : “ভালোবাসার রঙ”
২০১২ সাল ঢালিউডের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। কারণ, সেই বছরই মুক্তি পায় জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত “ভালোবাসার রঙ”। এই ছবির নায়িকা হিসেবে অভিষেক হয় মাহিয়া মাহির। তার বিপরীতে ছিলেন বাপ্পী চৌধুরি। ছবিটি মুক্তির পরই দর্শক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তরুণ প্রজন্মের কাছে মাহির সতেজ সৌন্দর্য, সহজ অভিনয় এবং প্রাণবন্ত উপস্থিতি ছিল একেবারেই নতুন। সমালোচকরাও প্রশংসায় ভাসান। বলা হয়, “ভালোবাসার রঙ” আসলে নতুন ঢালিউড যুগের সূচনা করেছিল।
সাফল্যের সোপান : একের পর এক জনপ্রিয় ছবি
অভিষেকের পর মাহির ক্যারিয়ার থেমে থাকেনি। তিনি একের পর এক আলোচিত ও সফল ছবিতে অভিনয় করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য –
পোড়ামন (২০১৩)
রফিক শিকদার পরিচালিত এই ছবিতে মাহি অভিনয় করেন নায়িকা রোজার চরিত্রে। একটি গ্রামের মেয়ে, যার প্রেমের গল্প দারুণ আবেগীভাবে ফুটে ওঠে। শাকিব খানের বিপরীতে অভিনীত এই ছবি ব্যবসায়িকভাবে বিশাল সাফল্য পায়। সমালোচকরা বলেন, মাহির অভিনয় এতটাই প্রাণবন্ত ছিল যে দর্শকরা চরিত্রের সঙ্গে আবেগে একাত্ম হয়ে পড়েছিলেন।
অগ্নি (২০১৪)
এই ছবির মাধ্যমে মাহির ক্যারিয়ারে আসে বড় বাঁক। অ্যাকশনধর্মী নারী চরিত্রে অভিনয় করে তিনি দেখান যে শুধু রোমান্টিক নায়িকা নয়, শক্তিশালী চরিত্রও সমান দক্ষতায় করতে পারেন। “অগ্নি”-তে একজন নারী প্রতিশোধযোদ্ধার চরিত্রে তার উপস্থিতি নারী দর্শকদের কাছেও প্রবল সাড়া তোলে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নারী অ্যাকশন হিরো চরিত্রের সফল উদাহরণ হিসেবে এখনো “অগ্নি” আলোচিত।
অগ্নি-২ (২০১৫)
প্রথম কিস্তির বিপুল সাফল্যের কারণে নির্মিত হয় “অগ্নি-২”। এবারও মাহি ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। ছবির আন্তর্জাতিক শুটিং, আধুনিক কাহিনি এবং মাহির দুর্দান্ত উপস্থিতি এটিকে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজি করে তোলে।
ঢাকা অ্যাটাক (২০১৭)
ওয়াজেদ আলী সুমন পরিচালিত এই পুলিশি থ্রিলারে মাহি অভিনয় করেন সাংবাদিক চরিত্রে। আরিফিন শুভর সঙ্গে তার জুটি দর্শকদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়। ছবিটি শুধু ব্যবসায়িকভাবেই নয়, সমালোচনামূলকভাবেও প্রশংসা পায়। অনেক সমালোচক বলেন, এটি আধুনিক ঢাকাই সিনেমার মান নির্ধারণ করে দিয়েছে।
হৃদয় যে আমার নাম (২০১৪)
রোমান্টিক ঘরানার এই ছবিতে মাহির অভিনয় দর্শক হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তিনি আবার প্রমাণ করেন যে আবেগঘন চরিত্রেও তিনি স্বতঃস্ফূর্ত।
অভিনয়ের ধরণ ও বৈচিত্র্য
মাহির অভিনয়ের শক্তি হলো তার স্বাভাবিকতা। তিনি সংলাপ উচ্চারণে কৃত্রিমতা পরিহার করে চরিত্রকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন। নাটকীয় দৃশ্যে তার আবেগপ্রকাশ, আর হালকা মুহূর্তে তার প্রাণবন্ততা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। রোমান্টিক, অ্যাকশন, থ্রিলার কিংবা সামাজিক—সব ধরনের ঘরানায় তিনি সমান দক্ষ।
জনপ্রিয়তার শীর্ষে মাহি
২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল ছিল মাহির স্বর্ণযুগ। একের পর এক হিট ছবি এবং তারকাখ্যাতি তাকে ঢালিউডের সবচেয়ে আলোচিত নায়িকায় পরিণত করে। প্রযোজক-পরিচালকরা তাকে ঘিরে নতুন ছবির পরিকল্পনা করতেন। তার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন সব শীর্ষ নায়ক। দর্শকের কাছেও তিনি ছিলেন “ঢালিউড কুইন”।
ব্যক্তিজীবন
২০১৬ সালে মাহি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সিলেটের ব্যবসায়ী মাহমুদ পারভেজ অপুর সঙ্গে। বিয়েটি ছিল বেশ আলোচিত। তবে কয়েক বছরের মধ্যে সেই সম্পর্কে ভাঙন আসে। পরবর্তীতে ২০২১ সালে তিনি গাজীপুরের রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী রাকিব সরকারের সঙ্গে বিবাহ করেন। ২০২৩ সালে তিনি সন্তানের মা হন। মাতৃত্বের এই অধ্যায় তাকে নতুনভাবে পরিপূর্ণ করেছে।
সামাজিক কর্মকাণ্ড ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা
রাকিব সরকারের সঙ্গে বিবাহের পর মাহি গাজীপুরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি স্থানীয় উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নেন এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তিনি প্রায়ই সামাজিক সমস্যা ও সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরেন।
বিতর্ক ও সমালোচনা
মাহির ক্যারিয়ার যেমন সাফল্যে ভরপুর, তেমনি বিতর্কেও ঘেরা। কখনো ছবি চুক্তি ভঙ্গ, কখনো ব্যক্তিজীবনের সিদ্ধান্ত, আবার কখনো রাজনৈতিক মন্তব্য – সবই তাকে আলোচনায় রেখেছে। তবে তিনি প্রতিটি সময় দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, “সমালোচনা আমাকে আরও শক্তিশালী করে।”
অবদান ও উত্তরাধিকার
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মাহির সবচেয়ে বড় অবদান হলো নতুন প্রজন্মকে সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট করা। একসময় দর্শক প্রেক্ষাগৃহ বিমুখ ছিল, তখন “পোড়ামন” বা “অগ্নি”র মতো ছবি প্রেক্ষাগৃহে তরুণদের ফিরিয়ে আনে। নারী চরিত্রকে শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করায় তাকে ঢালিউডে নারী ক্ষমতায়নের প্রতীক বলা হয়।
বর্তমান অবস্থান
বর্তমানে মাহি অভিনয়ে আগের মতো নিয়মিত নন। তবে তিনি বেছে কাজ করছেন। সামাজিক কর্মকাণ্ড, পরিবার ও রাজনীতির কাজ নিয়েই তিনি বেশি ব্যস্ত। তবুও ভক্তরা এখনো তার নতুন ছবির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যেমন ওয়েব সিরিজ, ওটিটি কনটেন্টের উত্থান ঘটেছে। মাহি চাইলে এই প্ল্যাটফর্মে নতুন রূপে হাজির হতে পারেন। তার বহুমাত্রিক প্রতিভা ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রেও কাজ করার সুযোগ আছে। একইসঙ্গে তিনি রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
মাহিয়া মাহি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন এক নায়িকা, যিনি একাধারে নায়িকা, সমাজকর্মী, স্ত্রী, মা ও সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার জীবনের গল্প শুধু সাফল্যের নয়; সংগ্রাম, সমালোচনা ও আত্মপ্রত্যয়েরও গল্প। তিনি প্রমাণ করেছেন, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাস থাকলে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা সম্ভব। আগামী প্রজন্মও তাকে স্মরণ করবে একজন সংগ্রামী ও অনুপ্রেরণাদায়ী শিল্পী হিসেবে।