২০১৬ সালে ভারতের দেউলিয়া আইন চালুর সময় এটি ‘ঋণখেলাপিদের স্বর্গের অবসান’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু প্রায় এক দশক পর দেখা যাচ্ছে, প্রতিশ্রুত সংস্কারের অনেকটাই বাস্তবে ব্যর্থ হয়েছে। আদালতের বিলম্ব, দুর্বল অবকাঠামো এবং প্রশাসনিক জটিলতায় ব্যবসায়ীরা আজও কাঙ্ক্ষিত ফল পাচ্ছেন না।
দেউলিয়া আইনের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি
ভারতে দেউলিয়া কোড চালুর আগে একটি কোম্পানির দেউলিয়া প্রক্রিয়া শেষ হতে গড়ে ৪.৩ বছর সময় লাগত—চীনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। নতুন আইনের লক্ষ্য ছিল সেই সময়সীমা কমিয়ে ২৭০ দিনে আনা। একই সঙ্গে, ঋণদাতারা যেন পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ অর্থ উদ্ধার করতে পারেন—এমন আশাও দেওয়া হয়েছিল।
বাস্তবে কী ঘটেছে
প্রায় ৮ হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিন-পঞ্চমাংশের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু চারটির মধ্যে তিনটি মামলাই নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রম করেছে। বর্তমানে চলমান ১,৯০০ মামলার ৭৮ শতাংশই ২৭০ দিনের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে—গত বছরের জুনে যা ছিল ৬৮ শতাংশ। ‘কেয়ারএজ রেটিংস’-এর গবেষণা অনুযায়ী, ঋণ পুনরুদ্ধার হার মাত্র ৩২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা প্রত্যাশার তুলনায় খুবই কম।

আদালতের বিলম্ব ও প্রশাসনিক দুর্বলতা
আদালতের ধীরগতিই অন্যতম বড় সমস্যা। একটি আর্থিক পরামর্শ সংস্থার পরিচালক আবিজার দিওয়ানজি বলেন, “আমাদের আদালত তাড়াহুড়ো করে না।” আইনের ধারায় ১০ মিলিয়ন রুপির (প্রায় ১ লক্ষ ১৩ হাজার ডলার) বেশি ঋণখেলাপি হলে মামলা করা যায়, কিন্তু বাস্তবে আদালতে গ্রহণযোগ্যতা পেতে দুই বছর পর্যন্ত লেগে যায়।
অবকাঠামোগত সংকট ও বিচারক নিয়োগে সমস্যা
আদালতগুলোতে জায়গার অভাব, ভাঙা এয়ার কন্ডিশন, মামলাকারীদের বসার স্থান নেই—এসব এখন নিয়মিত দৃশ্য। অনেক বিচারক অদক্ষ, কেউ কেউ দুর্নীতির অভিযোগেও জড়িত। দেউলিয়া আইনজীবী সুমন্ত বাত্রা বলেন, “শিল্পখাতের বিশেষজ্ঞদের বদলে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের নিয়োগ দেওয়ায়, দক্ষতার ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।” এসব কারণে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। এমনকি স্বেচ্ছায় ব্যবসা বন্ধের প্রক্রিয়াও গড়ে ৪.৩ বছর সময় নেয়, যার মধ্যে প্রায় তিন বছর কেবল সরকারি ছাড়পত্র পেতে সময় লেগে যায়।
আদালতের হস্তক্ষেপ ও শিল্পক্ষেত্রে প্রভাব
২০২৫ সালের মে মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে জেএসডব্লিউ স্টিলের ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ‘ভূষণ পাওয়ার অ্যান্ড স্টিল’ অধিগ্রহণ বাতিল করে দেয়। তবে শিল্পখাতের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে সেপ্টেম্বরে রায়টি আবার প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে, বিচারপ্রক্রিয়ার অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা শিল্পখাতকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

সরকারের নতুন সংস্কার প্রস্তাব
২০২৫ সালের আগস্টে সরকার একগুচ্ছ সংশোধনী প্রস্তাব করেছে।
- যাচাইকৃত ঋণখেলাপি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির আওতায় আনা হবে।
- ‘ক্লিন-স্লেট’ বিধান চালু করে পুরোনো দাবি বাতিলের মাধ্যমে মামলা-সংক্রান্ত জটিলতা কমানো হবে।
- আদালতের বাইরে সমঝোতার নতুন ব্যবস্থা চালু করা হবে, যাতে প্রকৃত ব্যর্থ ব্যবসাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি পায়।
দেউলিয়া বিষয়ক প্রাক্তন নিয়ন্ত্রক এম. এস. সাহু মনে করেন, এসব সংশোধনী আইনটির “মূল উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হবে।”
ভারতের দেউলিয়া আইনটি যেভাবে একসময় অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছিল, এখন তা নিজেই জটিলতার ফাঁদে আটকা পড়েছে। সময় এসেছে সরকার ও বিচার বিভাগ একযোগে কাজ করে ব্যবসা-বান্ধব সংস্কার কার্যকর করার—অন্যথায় ‘ঋণখেলাপিদের স্বর্গ’ হয়তো আবার ফিরে আসবে।
# ভারত, দেউলিয়া আইন, আদালত বিলম্ব, অর্থনীতি, ব্যবসা সংস্কার, সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















