নেদারল্যান্ডস সরকারের হস্তক্ষেপে চীনা মালিকানাধীন চিপ প্রস্তুতকারক নেক্সপেরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন উত্তেজনা শুরু হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বেইজিং রপ্তানি সীমিত করায় গাড়ি নির্মাতারা পড়েছে বড় সংকটে, যা বিশ্বব্যাপী অটো সরবরাহ শৃঙ্খলে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।
নেক্সপেরিয়া সংকটে বৈশ্বিক প্রভাব
চীনের নতুন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা গাড়ির জন্য ব্যবহৃত চিপ ও উপাদানের ওপর প্রযোজ্য হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় নেদারল্যান্ডস সরকারের পক্ষ থেকে চীনা মালিকানাধীন নেক্সপেরিয়ার কার্যক্রমে হস্তক্ষেপের পর। সরকার জানায়, প্রতিষ্ঠানটিতে “গভীর প্রশাসনিক ত্রুটি” পাওয়া গেছে এবং এটি ইউরোপের সেমিকন্ডাক্টর খাতে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি তৈরি করছে।
নেক্সপেরিয়া মূলত নেদারল্যান্ডসের নাইমেইখেন শহরে সদরদপ্তর স্থাপন করে পরিচালিত হয় এবং ২০১৯ সালে চীনা কোম্পানি উইংটেক টেকনোলজি সেটি অধিগ্রহণ করে।
জিএম-এর সতর্কতা ও উদ্বেগ
জেনারেল মোটরসের চেয়ারম্যান ও সিইও মেরি বারা জানিয়েছেন, চীনের রপ্তানি সীমাবদ্ধতা তাদের গাড়ি উৎপাদনে “গুরুতর প্রভাব” ফেলতে পারে। তিনি বলেন, “আমাদের অভ্যন্তরীণ দল ও সরবরাহকারীরা দিনরাত কাজ করছে যাতে উৎপাদন ব্যাহত না হয়।”

তিনি পরিস্থিতিকে “অত্যন্ত অনিশ্চিত” বলে বর্ণনা করেন এবং ভবিষ্যতে হালনাগাদ জানাবেন বলে উল্লেখ করেন।
ডাচ সরকারের সিদ্ধান্ত
নেদারল্যান্ডস সরকার “গুডস অ্যাভেইলিবিলিটি অ্যাক্ট” ব্যবহার করে নেক্সপেরিয়ার কার্যক্রমে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেয়। দেশটির অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রী ভিনসেন্ট কারেমানস পার্লামেন্টে পাঠানো এক চিঠিতে লেখেন, প্রতিষ্ঠানটি ডাচ ও ইউরোপীয় সেমিকন্ডাক্টর খাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাই এর কার্যক্রমে বিদেশি অনিয়ন্ত্রিত প্রভাব থাকা নিরাপদ নয়।
তিনি আরও জানান, তদন্তে দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানটির কিছু সম্পদ ও মেধাস্বত্ব বিদেশি মালিকের নামে স্থানান্তরিত হয়েছে। এর ফলে উইংটেকের সিইও ঝাং শুঝেংকে নেক্সপেরিয়ার পরিচালকের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়।
চীনের পাল্টা পদক্ষেপ
প্রতিশোধমূলকভাবে চীন নেক্সপেরিয়ার চীনা শাখা ও এর সহযোগীদের কিছু “নির্দিষ্ট উপাদান ও উপসমাহার” রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই পদক্ষেপের ফলে বৈশ্বিক গাড়ি শিল্পে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, কারণ নেক্সপেরিয়া বিশ্বব্যাপী গাড়ির ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল ইউনিটে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ চিপ সরবরাহ করে থাকে।
ইউরোপীয় গাড়ি নির্মাতাদের আতঙ্ক
জার্মান অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র সিমন শুটজ বলেন, “নেক্সপেরিয়া আমাদের গাড়ি শিল্পের অন্যতম প্রধান চিপ সরবরাহকারী। তাদের সরবরাহ বন্ধ হলে অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”

নেক্সপেরিয়া ১০ অক্টোবর জার্মান গাড়ি প্রস্তুতকারকদের জানায় যে তারা সম্পূর্ণভাবে সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহু কোম্পানি জরুরি সমাধান খুঁজছে।
ইউরোপীয় অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (ACEA) জানায়, বর্তমান মজুদ কেবল কয়েক সপ্তাহ টিকবে। বিকল্প সরবরাহকারীদের খোঁজ চলছে, তবে নতুন চিপ উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খল স্থাপন করতে কয়েক মাস সময় লাগবে।
জাপানি বাজারেও প্রতিক্রিয়া
নেক্সপেরিয়া জাপানের গ্রাহকদেরও সতর্ক করে জানিয়েছে যে এটি “ফোর্স মাজোর” পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, অর্থাৎ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
হোন্ডা মোটর জানিয়েছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং এখনো উৎপাদনে প্রভাব পড়েনি। তবে কিছু যন্ত্রাংশে নেক্সপেরিয়া চিপ ব্যবহৃত হওয়ায় ভবিষ্যতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
একই সময়ে জাপানের বিভিন্ন সেমিকন্ডাক্টর ডিস্ট্রিবিউটর জানাচ্ছে, নেক্সপেরিয়ার বিকল্প হিসেবে টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টসসহ অন্যান্য কোম্পানির চিপের চাহিদা পাঁচগুণ বেড়ে গেছে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এই বিরোধ হঠাৎ তৈরি হয়নি। গত বছর ডিসেম্বর মাসে মার্কিন বাণিজ্য বিভাগ উইংটেককে “এন্টিটি লিস্ট”-এ যুক্ত করে, যেখানে জাতীয় নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকির কারণে কোম্পানিগুলোর ওপর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, উইংটেক চীনের প্রতিরক্ষা শিল্পে ব্যবহারযোগ্য সংবেদনশীল সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি সংগ্রহের চেষ্টা করছে।
উইংটেকের চেয়ারম্যান ইয়াং মু সম্প্রতি এক বিনিয়োগকারীদের বৈঠকে বলেন, “আমরা চীনে আমাদের সম্পদ ও কার্যক্রমের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি।”
কূটনৈতিক যোগাযোগ
পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় নেদারল্যান্ডস ও চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীরা টেলিফোনে কথা বলেন। চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও তার ডাচ সমকক্ষকে অনুরোধ করেন “চুক্তির মর্যাদা ও বাজারভিত্তিক আইনের নীতি রক্ষা করে চীনা বিনিয়োগকারীদের আইনি অধিকার সুরক্ষিত রাখতে।”
অন্যদিকে, ডাচ মন্ত্রী কারেমানস বলেন, উভয় দেশ “গঠনমূলক সমাধান” খোঁজে একমত হয়েছে, যদিও এখনো কোনো বাস্তব চুক্তি হয়নি।
নেক্সপেরিয়াকে ঘিরে চীন-পশ্চিমের এই সংঘাত বিশ্বব্যাপী গাড়ি শিল্পে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর নির্ভরশীলতা আরও স্পষ্ট হয়েছে, এবং এটি প্রমাণ করছে—প্রযুক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন কেবল চিপ বা উৎপাদন নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির ভিত্তিকেও নাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
# নেক্সপেরিয়া, চীন, নেদারল্যান্ডস, সেমিকন্ডাক্টর, গাড়ি শিল্প, সরবরাহ শৃঙ্খল, জেনারেল মোটরস, ইউরোপ, প্রযুক্তি যুদ্ধ
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















