নতুন প্রজন্ম, নতুন কূটনীতি
প্রজন্ম জেড—যাদের জন্ম নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১০–এর শুরুর দিকে—ইতিহাসের সবচেয়ে ডিজিটালি সচেতন প্রজন্ম। একই সঙ্গে তারা বৈশ্বিকভাবে সংযুক্ত, মূল্যবোধ–নির্ভর ও অংশগ্রহণে বিশ্বাসী। জনকূটনীতির (Public Diplomacy) ক্ষেত্রে এই প্রজন্ম একদিকে বড় চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে নতুন সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে। তাদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে হলে কূটনৈতিক সংস্থাগুলোকে ভাবতে হবে নতুনভাবে—উদ্দেশ্য, মাধ্যম ও অংশগ্রহণের কাঠামো পুনর্গঠনের প্রয়োজন রয়েছে।
প্ল্যাটফর্মের পরিবর্তন: দৃশ্যভিত্তিক যোগাযোগ
এই প্রজন্ম সংবাদপত্র বা টেলিভিশন নয়, বরং ইউটিউব শর্টস, ইনস্টাগ্রাম রিলস কিংবা অন্যান্য মোবাইল–ভিত্তিক ভিজ্যুয়াল প্ল্যাটফর্ম থেকে তথ্য গ্রহণ করে। প্রচলিত মিডিয়ার ওপর নির্ভরতা তাদের কম।
কর্তৃত্ব নয়, বিশ্বাসযোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ
প্রজন্ম জেড উপরের দিক থেকে চাপানো বার্তা বা আনুষ্ঠানিক কর্তৃত্বকে খুব একটা বিশ্বাস করে না। তারা স্বচ্ছতা, বাস্তবতা ও আন্তরিকতা খোঁজে—যেখানে বার্তাবাহক হতে পারে তরুণ নেতৃত্ব, মাইক্রো–ইনফ্লুয়েন্সার বা সাধারণ কনটেন্ট নির্মাতারা যাদের তারা অনুসরণ করে।
অংশগ্রহণই তাদের প্রত্যাশা
এই প্রজন্ম ইন্টারঅ্যাকশনের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। অনলাইন ভোট, প্রশ্নোত্তর, লাইভ চ্যাট কিংবা প্রতিক্রিয়া বিনিময়—সবকিছুই তাদের কাছে অপরিহার্য। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এই অংশগ্রহণের সুযোগ না দেয়, তবে তারা বিশ্বাস হারায়।
মূল্যবোধ ও বৈশ্বিক সচেতনতা
প্রজন্ম জেড জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, সমতা, মানসিক স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলোকে “অতিরিক্ত” নয় বরং মূল নীতি হিসেবে দেখে। তাদের কূটনৈতিক অগ্রাধিকারের কেন্দ্রবিন্দু হলো সামাজিক ন্যায্যতা ও টেকসই ভবিষ্যৎ।
সংস্কৃতির সীমানা ভাঙা
এই প্রজন্মের জন্য জাতি বা সীমান্তের চেয়ে অনলাইন সংস্কৃতি ও বৈশ্বিক পরিচয় বেশি অর্থবহ। তারা ভার্চুয়াল আন্দোলন, আন্তর্জাতিক সংহতি ও ট্রান্সন্যাশনাল অ্যাক্টিভিজমের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত।
ক্ষমতার প্রতি সন্দেহ
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নানা কেলেঙ্কারির সময় বেড়ে ওঠায়, তারা ক্ষমতার কাঠামো নয়—জবাবদিহিতা চায়। এই কারণে প্রথাগত কূটনৈতিক ভাষা বা একমুখী প্রচারণা তাদের কাছে আর প্রভাবশালী নয়।
নতুন কূটনৈতিক ভাষা: গল্পের মাধ্যমে সংযোগ
জনকূটনীতিকে এখন এমন বর্ণনাভিত্তিক ফরম্যাটে উপস্থাপন করতে হবে যা প্রজন্ম জেড গ্রহণ করে। বড় রাষ্ট্রীয় প্রচারণার চেয়ে ৬০ সেকেন্ডের বাস্তব ভিডিও বা ব্যবহারকারীদের তৈরি সচেতনতামূলক চ্যালেঞ্জ এখন বেশি কার্যকর।

সহযোগিতার কূটনীতি
কূটনীতি এখন আর একমুখী নির্দেশ নয়—এটি হতে হবে যৌথ প্রচেষ্টা। এজন্য রাষ্ট্রগুলোকে
- • তরুণ কূটনীতি ও নাগরিক প্রযুক্তি (civic-tech) প্রকল্পে সহায়তা দিতে হবে
- • তরুণ কূটনীতিকদের সিদ্ধান্ত–গ্রহণ পর্যায়ে স্থান দিতে হবে
- • প্রজন্ম জেড–কে নীতিনির্ধারণের সহ–স্রষ্টা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে
তথ্যযুদ্ধ ও ডিজিটাল সাক্ষরতা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–নির্ভর ভুয়া খবর ও “ডিপফেইক” বেড়ে যাওয়ায়, জনকূটনীতি এখন শুধু বার্তা প্রচার নয়—বরং ডিজিটাল সচেতনতা তৈরির প্রক্রিয়া। সত্য যাচাইযোগ্য তথ্য, কমিউনিটি–ভিত্তিক বিশ্বাসযোগ্যতা ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া এখন অপরিহার্য।
উদ্দেশ্য ও প্রভাব স্পষ্ট করতে হবে
প্রজন্ম জেড জানতে চায়—‘কেন’ ও ‘এর পর কী’। তাই কূটনৈতিক বার্তায় স্পষ্টভাবে বলতে হবে: লক্ষ্য কী? কে লাভবান হবে? এটি ন্যায্যতা, সমতা বা টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত?

নতুন ধরনের রাজনৈতিক শক্তি
এই প্রজন্মের রাজনৈতিক প্রভাব কোনো আনুষ্ঠানিক কাঠামোয় নয়, বরং ভাইরাল সংগঠনে। জলবায়ু আন্দোলন থেকে ফিলিস্তিন সংহতি—তারা কোনো নেতা বা সীমান্ত ছাড়াই বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে তুলছে।
প্রভাবের নতুন রূপ
এই বিকেন্দ্রীভূত ও অরাজনৈতিক আন্দোলনগুলো দেখায়—প্রভাব এখন প্রতিষ্ঠানের নয়, বরং সহকর্মী ও সহযোদ্ধাদের দ্বারা তৈরি। তাই কূটনীতিকদের বুঝতে হবে, বৈধতা এখন “উপর থেকে দেওয়া অনুমতি” নয়, বরং “সমাজে গড়ে ওঠা বিশ্বাস।”
বিশ্বনীতিতে জেড প্রজন্মের প্রভাব
ওয়াশিংটন, ব্রাসেলসসহ বিশ্বের বিভিন্ন কূটনৈতিক অঙ্গনে প্রজন্ম জেড–এর চিন্তা ইতিমধ্যেই আলোচনার ধরন পাল্টে দিচ্ছে। তারা একতরফা নীতি নয়, বহুপাক্ষিকতা ও সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, যা নীতি–নির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
জনকূটনীতির রূপান্তর
আজ জনকূটনীতি মানে আর শুধু প্রচারণা নয়; এটি হলো কথোপকথন, সহ–সৃজন ও বিশ্বাসের প্রক্রিয়া। প্রজন্ম জেড অংশ নিতে অপেক্ষা করছে না—তারা ইতিমধ্যেই সক্রিয়। এখন চ্যালেঞ্জ কেবল প্রতিষ্ঠানগুলোর, কিভাবে তারা সেই গতির সঙ্গে তাল মিলাবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















