এক স্বপ্নের উড্ডয়ন
১৯৮৫ সালের ২৫ অক্টোবর সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে করাচির উদ্দেশে একটি এয়ারবাস এ-৩০০ যখন প্রথমবার উড্ডয়ন করে, তখন কেউ ভাবেনি এই ছোট্ট উদ্যোগই একদিন বিশ্বের অন্যতম সফল এয়ারলাইন হয়ে উঠবে। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স থেকে ধার করা পাইলট এবং মাত্র দুটি লিজ নেওয়া বিমান দিয়েই শুরু হয়েছিল যাত্রা। চার দশক পর এমিরেটস এয়ারলাইন আজ সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) উদ্ভাবন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বৈশ্বিক সংযোগের এক উজ্জ্বল প্রতীক—যা শুধু একটি বাণিজ্যিক সাফল্য নয়, বরং রাষ্ট্রের সফট পাওয়ারের শক্তির প্রতিচ্ছবি।
সীমিত বাজেট থেকে বৈশ্বিক সাফল্য
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে গালফ এয়ার যখন দুবাইয়ের সেবা কমিয়ে দেয়, তখন ইউএই-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নতুন একটি এয়ারলাইন গঠনের নির্দেশ দেন। তিনি ডিএনএটা’র প্রধান মরিস ফ্লানাগানকে মাত্র ১ কোটি মার্কিন ডলারের সীমিত বাজেটে এই দায়িত্ব দেন। সেই নির্দেশনাই আজ কিংবদন্তি। করাচি ও মুম্বাই—দুটি রুট দিয়ে যাত্রা শুরু করে এমিরেটস আজ ছয় মহাদেশে ১৫০টিরও বেশি গন্তব্যে উড়ছে, ২৭০টিরও বেশি বিমানের বহর নিয়ে, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম এয়ারবাস এ-৩৮০ এবং বোয়িং ৭৭৭ বহর।
এই সম্প্রসারণ দুবাইকে একটি আঞ্চলিক বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে বৈশ্বিক ব্যবসা, সংস্কৃতি ও পর্যটনের মিলনস্থলে পরিণত করেছে।
নরম কূটনীতির উড়ান
“ফ্লাই এমিরেটস” স্লোগান এবং আর্সেনাল, রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলানসহ বিশ্বের নামী ফুটবল ক্লাবগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা এমিরেটসকে বিশ্বজুড়ে এক সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পিজিএ ট্যুর থেকে শুরু করে দুবাই ওয়ার্ল্ড কাপ পর্যন্ত নানা আন্তর্জাতিক ইভেন্টে ব্র্যান্ডটির উপস্থিতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের নামকে উৎকর্ষ ও আধুনিকতার প্রতীকে পরিণত করেছে।
এভাবে এমিরেটস ইউএই-এর “ভিশন ২০২১” অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণ নীতির সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্তমানে দেশের জিডিপিতে তেলের অবদান মাত্র ১ শতাংশ, কিন্তু বিমান ও পর্যটন খাতের অবদান ১১ শতাংশেরও বেশি।
দুবাই বিমানবন্দর ও মহামারিকালে অভিযোজন
দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ২০২৩ সালে বিশ্বের সেরা বিমানবন্দর নির্বাচিত হয়, যেখানে প্রতিবছর ৮ কোটিরও বেশি যাত্রী চলাচল করেন। এখান থেকে বিশ্বের ৮০ শতাংশ জনসংখ্যার কাছে মাত্র আট ঘণ্টার দূরত্বে পৌঁছানো যায়। কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিশ্বজুড়ে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও এমিরেটস যাত্রীবাহী বিমানে মালামাল পরিবহনের ব্যবস্থা করে দ্রুত অভিযোজন ঘটায়—বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে মানবিক ভূমিকা রাখে।
নিরাপত্তা ও প্রযুক্তির মানদণ্ড
এমিরেটসের সাফল্যের অন্যতম ভিত্তি এর দুর্দান্ত নিরাপত্তা রেকর্ড। গত ৪০ বছরে কোম্পানিটি বৈশ্বিক বিমান সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম নিরাপদ হিসেবে পরিচিত। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, কঠোর রক্ষণাবেক্ষণ, এবং বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম তাদের এই মর্যাদা অর্জনে সহায়তা করেছে।
এছাড়া ইউএই-এর বেসামরিক বিমান চলাচলের নিরাপত্তা কাঠামোও অসাধারণ—বিশ্বমানের স্ক্রিনিং, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কঠোর অনুশাসন এবং নির্ভরযোগ্য অবকাঠামো এমিরেটসের যাত্রীদের জন্য ভ্রমণকে করে তুলেছে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত।
সাশ্রয়ী বিলাসিতা ও সাংস্কৃতিক দূতাবাস
এমিরেটস ‘অ্যাক্সেসেবল লাক্সারি’ বা ‘সবার নাগালে বিলাসিতা’-এর ধারণা বাস্তবায়ন করেছে। বিমানে গুরমে খাবার, প্রিমিয়াম বিনোদন ও বহু ভাষাভাষী ক্রু যাত্রীদের এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়। তাদের লয়্যালটি প্রোগ্রাম, আরামদায়ক লাউঞ্জ এবং বিনামূল্যে ট্রানজিট প্যাকেজ অনেক যাত্রীকে দুবাইয়ের আতিথেয়তা সরাসরি উপভোগের সুযোগ দেয়—যা প্রায়শই স্টপওভারকে একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন অভিজ্ঞতায় পরিণত করে।
এটি ইউএই-এর ব্র্যান্ডিং কৌশলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা দুবাইকে “বিশ্বের বিস্ময়ের শহর” হিসেবে উপস্থাপন করে—বুর্জ খলিফা, ব্যস্ততম বিমানবন্দর, এবং বিলাসবহুল কেনাকাটার অভিজ্ঞতার জন্য পরিচিত। প্রতিটি এমিরেটস ফ্লাইট যেন ইউএই-এর উদ্ভাবন, সহনশীলতা ও বিশ্বসংযোগের এক সযত্ন প্রতিচ্ছবি।
টেকসই ভবিষ্যতের পথে
পঞ্চম দশকে প্রবেশ করা এমিরেটস এখন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে—টেকসই জ্বালানি, ডিজিটাল রূপান্তর ও যাত্রীদের পরিবর্তিত প্রত্যাশা। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যেই টেকসই বিমান জ্বালানি (এসএএফ) বিনিয়োগ, আরও জ্বালানি-দক্ষ এয়ারবাস A350 এবং বোয়িং ৭৭৭এক্স সংযোজন, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত পরিচালন ব্যবস্থার মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের গর্ব ও উত্তরাধিকার
করাচি থেকে প্রথম ফ্লাইটের চার দশক পরও এমিরেটস ইউএই-এর সবচেয়ে দৃশ্যমান ও বিশ্বাসযোগ্য বৈশ্বিক প্রতীকের একটি। এটি মহাদেশ, সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়কে যুক্ত করেছে—ক্ষমতার প্রদর্শন নয়, বরং আস্থা, সংযোগ ও যত্নের মাধ্যমে।
এমিরেটস প্রমাণ করেছে যে, নেতৃত্ব ও দূরদৃষ্টির সমন্বয়ে একটি প্রতিষ্ঠান শুধু ব্যবসায়িক সাফল্য নয়, কূটনৈতিক শক্তিও হয়ে উঠতে পারে। আগামী ৪০ বছরে এমিরেটসের সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার হতে পারে এই শিক্ষা—বিশ্বে প্রভাব বিস্তার শক্তি প্রয়োগ করে নয়, বরং আস্থা, ভারসাম্য ও মানবিক উড্ডয়নের মাধ্যমেই সম্ভব।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















