০৯:২২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৭৭) প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩৪৪) পাঁচ হাজার ডলারের পথে সোনা, ২০২৬ সালেও ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকার আভাস জানুয়ারি থেকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমছে, ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফা কাটছাঁট স্বর্ণের দামে নতুন ইতিহাস, আউন্সপ্রতি ছাড়াল ৪৪০০ ডলার এনসিপি নেতাকে গুলি: নারী সঙ্গী পলাতক, ফ্ল্যাট থেকে মাদকসংশ্লিষ্ট আলামত উদ্ধার তারেক রহমানের দেশে ফেরা সামনে রেখে শঙ্কার কথা জানালেন মির্জা আব্বাস গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোটের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার ওসমান হাদির বোন পাচ্ছেন অস্ত্রের লাইসেন্স ও গানম্যান তিন যুগ, তিন ফাইনাল, একই বাধা ভারত—সারফরাজের নামেই আবার পাকিস্তানের জয়গাথা

আমেরিকা ফার্স্ট হলেও আফ্রিকা যেন শেষ না হয়

পিএপিএফএআর থেকে আজকের সংকট

২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ এক যুগান্তকারী কর্মসূচি শুরু করেছিলেন—‘প্রেসিডেন্টস এমার্জেন্সি প্ল্যান ফর এইডস রিলিফ’ বা পিএপিএফএআর। এই কর্মসূচি মূলত আফ্রিকায় এইচআইভি-এইডস প্রতিরোধে নিবেদিত ছিল এবং ইতিমধ্যে ২ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। কিন্তু আজ এই কর্মসূচিটি যেন অতীতের কোনো প্রতীক—এক সময়ের সেই যুগের চিহ্ন, যখন ধনী দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে আগ্রহী ছিল।

সাহায্যের কাঠামো ভেঙে পড়া

একসময় আফ্রিকার সাহারা-দক্ষিণাঞ্চলে স্বাস্থ্য সহায়তার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দিত যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএইড) কার্যত ভেঙে ফেলেছে—যে সংস্থার মাধ্যমে বিদেশে সাহায্য পাঠানো হতো। আগামী বছরগুলোতে বড় ধরনের আরও কাটছাঁটের প্রস্তাবও এসেছে, যা অন্যান্য বড় দাতাদের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি করেছে। সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ না হলেও এখন প্রতিটি ডলার কোথায় খরচ হচ্ছে তা নিয়ে বেশি সচেতনতা দরকার।

এই কাঠামো ভেঙে পড়ায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। মার্কো রুবিও, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দাবি করেছেন এতে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-অর্থায়িত ডেটা সিস্টেম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকৃত পরিস্থিতি যাচাই করা কঠিন। দক্ষিণ আফ্রিকার বহু ক্লিনিকে এইচআইভি রোগীদের জন্য অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ (এআরভি) ফুরিয়ে গেছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য চালু থাকা অনেক প্রকল্প বন্ধ হয়েছে। অন্যান্য আফ্রিকান দেশে ম্যালেরিয়া চিকিৎসা সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় সংক্রমণ বাড়ছে। কলেরায় মৃত্যুর হার বেড়েছে, টিকাদান অভিযান স্থগিত, শরণার্থী শিবিরে খাদ্য বরাদ্দ কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে লাখো অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটতে পারে। যদিও সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব নয়, মৃত্যুহার শূন্যে থাকবে না—এটা নিশ্চিত।

নতুন নীতির অর্ধেক আলো, অর্ধেক অন্ধকার

যদিও পরিস্থিতি ভয়াবহ, সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট গ্লোবাল হেলথ স্ট্র্যাটেজি’ ইঙ্গিত দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি আফ্রিকা থেকে সরে যাচ্ছে না। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো আমেরিকান নাগরিকদের সংক্রামক রোগ থেকে সুরক্ষা দেওয়া। এতে বলা হয়েছে, অকার্যকর বেসরকারি সংগঠনগুলোর (এনজিও) প্রকল্প বাদ দিয়ে সরাসরি আফ্রিকান সরকারগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা হবে, যাতে তারা ‘সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরতা’ অর্জন করতে পারে।

তবে বাস্তবে, দ্বিপাক্ষিক স্বাস্থ্য সহায়তা দুই-তৃতীয়াংশ কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের দাবি, তারা “অগ্রভাগের” কাজে অর্থ ব্যয় করবে, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাবে।

নীতির সমস্যা ও বাস্তবতা

এই কৌশলে কিছু ইতিবাচক দিক আছে। সত্যিই, আমেরিকান সাহায্য অনেক আফ্রিকান দেশে নির্ভরতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে। নির্দিষ্ট রোগের ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়ায় পৃথক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে। তবুও, এই নীতি নিজেই নিজের লক্ষ্যকে বিপন্ন করছে। সংক্রমণ শনাক্তকরণের কার্যক্রমে অর্থকর্তন করা হলে সীমান্ত পেরিয়ে রোগ ছড়ানো ঠেকানো সম্ভব হবে না। দরিদ্র আফ্রিকান দেশগুলোর পক্ষে নিজস্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন হবে যদি পর্যাপ্ত অর্থ সহায়তা না থাকে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সুযোগ

বৈপরীত্য হলো, বর্তমানে এমন অনেক প্রযুক্তি এসেছে যা সাহায্য কার্যক্রমকে আরও দক্ষ ও কম জটিল করে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নতুন ম্যালেরিয়া টিকা ও আধুনিক এআরভি ওষুধ বছরে মাত্র দুইবার গ্রহণ করলেই কার্যকর থাকে। ফলে বিশাল এনজিও-নির্ভর কার্যক্রমের প্রয়োজন কমবে—যেগুলো ট্রাম্প প্রশাসন বাদ দিতে চাইছে। কিন্তু এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্যও কিছু অর্থ দরকার, এবং সরকারগুলোর সেই সহায়তা ছাড়া তা সম্ভব নয়।

নৈতিক ও কৌশলগত ভারসাম্য

বুশ একসময় বলেছিলেন, “আফ্রিকায় জীবন রক্ষা করা আমাদের কৌশলগত ও নৈতিক স্বার্থের অংশ।” আজও অধিকাংশ রিপাবলিকানরা গণতন্ত্র প্রচার বা সাংস্কৃতিক সহায়তায় অর্থ ব্যয়ে অনীহা দেখালেও, প্রায় ৭৫ শতাংশ এখনো জীবনরক্ষাকারী সাহায্যের পক্ষে। তাদের এই মানবিক প্রবৃত্তিই সঠিক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সহযোগিতায় “আমেরিকা ফার্স্ট” মানে যেন “আফ্রিকা লাস্ট” না হয়—এই বার্তাই এখন সবচেয়ে জরুরি। মানবিক সহায়তার ইতিহাস প্রমাণ করেছে, নৈতিক দায়িত্ব ও কৌশলগত দূরদৃষ্টি একে অপরের পরিপূরক হতে পারে। আফ্রিকাকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেও নিরাপদ থাকতে পারবে না।

জনপ্রিয় সংবাদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৭৭)

আমেরিকা ফার্স্ট হলেও আফ্রিকা যেন শেষ না হয়

০৭:৩৮:২২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ নভেম্বর ২০২৫

পিএপিএফএআর থেকে আজকের সংকট

২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ এক যুগান্তকারী কর্মসূচি শুরু করেছিলেন—‘প্রেসিডেন্টস এমার্জেন্সি প্ল্যান ফর এইডস রিলিফ’ বা পিএপিএফএআর। এই কর্মসূচি মূলত আফ্রিকায় এইচআইভি-এইডস প্রতিরোধে নিবেদিত ছিল এবং ইতিমধ্যে ২ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। কিন্তু আজ এই কর্মসূচিটি যেন অতীতের কোনো প্রতীক—এক সময়ের সেই যুগের চিহ্ন, যখন ধনী দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে আগ্রহী ছিল।

সাহায্যের কাঠামো ভেঙে পড়া

একসময় আফ্রিকার সাহারা-দক্ষিণাঞ্চলে স্বাস্থ্য সহায়তার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দিত যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএইড) কার্যত ভেঙে ফেলেছে—যে সংস্থার মাধ্যমে বিদেশে সাহায্য পাঠানো হতো। আগামী বছরগুলোতে বড় ধরনের আরও কাটছাঁটের প্রস্তাবও এসেছে, যা অন্যান্য বড় দাতাদের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি করেছে। সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ না হলেও এখন প্রতিটি ডলার কোথায় খরচ হচ্ছে তা নিয়ে বেশি সচেতনতা দরকার।

এই কাঠামো ভেঙে পড়ায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। মার্কো রুবিও, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দাবি করেছেন এতে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-অর্থায়িত ডেটা সিস্টেম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকৃত পরিস্থিতি যাচাই করা কঠিন। দক্ষিণ আফ্রিকার বহু ক্লিনিকে এইচআইভি রোগীদের জন্য অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধ (এআরভি) ফুরিয়ে গেছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য চালু থাকা অনেক প্রকল্প বন্ধ হয়েছে। অন্যান্য আফ্রিকান দেশে ম্যালেরিয়া চিকিৎসা সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় সংক্রমণ বাড়ছে। কলেরায় মৃত্যুর হার বেড়েছে, টিকাদান অভিযান স্থগিত, শরণার্থী শিবিরে খাদ্য বরাদ্দ কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে লাখো অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটতে পারে। যদিও সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব নয়, মৃত্যুহার শূন্যে থাকবে না—এটা নিশ্চিত।

নতুন নীতির অর্ধেক আলো, অর্ধেক অন্ধকার

যদিও পরিস্থিতি ভয়াবহ, সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট গ্লোবাল হেলথ স্ট্র্যাটেজি’ ইঙ্গিত দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি আফ্রিকা থেকে সরে যাচ্ছে না। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হলো আমেরিকান নাগরিকদের সংক্রামক রোগ থেকে সুরক্ষা দেওয়া। এতে বলা হয়েছে, অকার্যকর বেসরকারি সংগঠনগুলোর (এনজিও) প্রকল্প বাদ দিয়ে সরাসরি আফ্রিকান সরকারগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা হবে, যাতে তারা ‘সম্পূর্ণ আত্মনির্ভরতা’ অর্জন করতে পারে।

তবে বাস্তবে, দ্বিপাক্ষিক স্বাস্থ্য সহায়তা দুই-তৃতীয়াংশ কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের দাবি, তারা “অগ্রভাগের” কাজে অর্থ ব্যয় করবে, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাবে।

নীতির সমস্যা ও বাস্তবতা

এই কৌশলে কিছু ইতিবাচক দিক আছে। সত্যিই, আমেরিকান সাহায্য অনেক আফ্রিকান দেশে নির্ভরতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে। নির্দিষ্ট রোগের ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়ায় পৃথক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে। তবুও, এই নীতি নিজেই নিজের লক্ষ্যকে বিপন্ন করছে। সংক্রমণ শনাক্তকরণের কার্যক্রমে অর্থকর্তন করা হলে সীমান্ত পেরিয়ে রোগ ছড়ানো ঠেকানো সম্ভব হবে না। দরিদ্র আফ্রিকান দেশগুলোর পক্ষে নিজস্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন হবে যদি পর্যাপ্ত অর্থ সহায়তা না থাকে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সুযোগ

বৈপরীত্য হলো, বর্তমানে এমন অনেক প্রযুক্তি এসেছে যা সাহায্য কার্যক্রমকে আরও দক্ষ ও কম জটিল করে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নতুন ম্যালেরিয়া টিকা ও আধুনিক এআরভি ওষুধ বছরে মাত্র দুইবার গ্রহণ করলেই কার্যকর থাকে। ফলে বিশাল এনজিও-নির্ভর কার্যক্রমের প্রয়োজন কমবে—যেগুলো ট্রাম্প প্রশাসন বাদ দিতে চাইছে। কিন্তু এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্যও কিছু অর্থ দরকার, এবং সরকারগুলোর সেই সহায়তা ছাড়া তা সম্ভব নয়।

নৈতিক ও কৌশলগত ভারসাম্য

বুশ একসময় বলেছিলেন, “আফ্রিকায় জীবন রক্ষা করা আমাদের কৌশলগত ও নৈতিক স্বার্থের অংশ।” আজও অধিকাংশ রিপাবলিকানরা গণতন্ত্র প্রচার বা সাংস্কৃতিক সহায়তায় অর্থ ব্যয়ে অনীহা দেখালেও, প্রায় ৭৫ শতাংশ এখনো জীবনরক্ষাকারী সাহায্যের পক্ষে। তাদের এই মানবিক প্রবৃত্তিই সঠিক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সহযোগিতায় “আমেরিকা ফার্স্ট” মানে যেন “আফ্রিকা লাস্ট” না হয়—এই বার্তাই এখন সবচেয়ে জরুরি। মানবিক সহায়তার ইতিহাস প্রমাণ করেছে, নৈতিক দায়িত্ব ও কৌশলগত দূরদৃষ্টি একে অপরের পরিপূরক হতে পারে। আফ্রিকাকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেও নিরাপদ থাকতে পারবে না।