দুবাইয়ের গুরুদ্বারা গুরু নানক দরবার, উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রথম সরকারি শিখ মন্দির, বিশ্বাস, সহনশীলতা ও মানবতার এক উজ্জ্বল প্রতীক। গুরু নানক দেব জির ৫৫৬তম জন্মবার্ষিকী (গুরুপুরব) উপলক্ষে এই গুরুদ্বারা আজ এবং আগামী ৯ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে আয়োজন করছে মহা উদযাপন।
গুরুপুরবের আধ্যাত্মিক আয়োজন:
গুরু নানক দেব জি — শিখ ধর্মের প্রবর্তক ও শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের চিরন্তন দূত — তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে গুরুদ্বারায় সারাদিন চলবে কীর্তন, পাঠ এবং গুরু কা লঙ্গর (সবার জন্য উন্মুক্ত ভোজ)। এই ভোজ শুধু ধর্মীয় নয়, মানবতার মিলনের এক প্রতীক, যেখানে সব ধর্ম ও জাতির মানুষ অংশ নেন।
দিনের শুরু হবে প্রভাতের ‘নিতনেম’ প্রার্থনা দিয়ে; এরপর পরিবেশিত হবে ‘আসা কি বার’ ও ‘সুখমণি সাহিব পাঠ’। দিনজুড়ে চলবে গুরু নানক দেব জির উপদেশভিত্তিক কীর্তন ও আধ্যাত্মিক পাঠ।
শহীদের দিবস পালন:
এ মাসের ২৫ ও ৩০ নভেম্বর গুরুদ্বারায় পালিত হবে নবম শিখ গুরু, গুরু তেগ বহাদুর সাহিব জির ৩৫০তম শহীদি দিবস। তাঁকে সম্মানিত করা হয় ‘হিন্দ দি চাদর’, তথা সমগ্র মানবতার রক্ষাকবচ হিসেবে। তাঁর আত্মত্যাগ ছিল শুধু এক ধর্মের জন্য নয়, বরং সবার আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার জন্য। কবি সেনাপতি তাঁর ১৭১৩ সালের ‘শ্রী গুরু সোভা’-তে লিখেছিলেন— “প্রগট भए গুরু তেগ বহাদুর, সগল সৃষ্ট भए ধাপি চাদর।”
এই উপলক্ষে বিশেষ কীর্তন, পাঠ এবং দিনব্যাপী লঙ্গরের আয়োজন থাকবে।

ভ্যাটিকান সিটির শুভেচ্ছা বার্তা:
এই বছর গুরুদ্বারার উদযাপনকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করেছে ভ্যাটিকান সিটির আন্তঃধর্মীয় সংলাপ দপ্তর (Dicastery for Interreligious Dialogue) ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থিত অ্যাপোস্টলিক নানসিয়েচার (হোলি সি দূতাবাস)। তাঁরা গুরু নানক প্রকাশ দিবস উপলক্ষে শিখ সম্প্রদায়ের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ জানিয়েছেন।
‘খ্রিস্টান ও শিখ: নোস্ত্রা এইতাতে’র চেতনায় মিলনের বার্তা’ শিরোনামে প্রকাশিত ভ্যাটিকানের বার্তায় বলা হয়েছে, “মানবজাতির সকল ধর্মই শান্তি, প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের এক সুতোয় বাঁধা।” বার্তাটি গুরুদ্বারা গুরু নানক দরবার দুবাইয়ের আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও সেবামূলক উদ্যোগের প্রশংসা করেছে।
নোস্ত্রা এইতাতে ঘোষণার ৬০ বছর:
এই শুভেচ্ছা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, কারণ ২০২৫ সালে পালিত হচ্ছে দ্বিতীয় ভ্যাটিকান কাউন্সিলের ঐতিহাসিক ঘোষণা ‘নোস্ত্রা এইতাতে’র ৬০তম বার্ষিকী। ১৯৬৫ সালে ঘোষিত এই নথি বিশ্বের ধর্মসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সংলাপ ও শ্রদ্ধার আহ্বান জানিয়েছিল। এতে বলা হয়, প্রতিটি মানুষের অন্তরে রয়েছে ঐশ্বরিক আলোক, আর সহমর্মিতা ও সত্যই সব ধর্মের মিলনস্থল।
রোমে অনুষ্ঠিত বার্ষিকী অনুষ্ঠান:
এই উপলক্ষে গত ২৮ ও ২৯ অক্টোবর রোমে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দুবাইয়ের গুরুদ্বারার পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত ধর্মীয় প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন ড. সুরিন্দর সিং কানধারি ও ড. বাবলস কানধারি। তাঁদের উপস্থিতি ছিল গুরুদ্বারার বৈশ্বিক মানবিক ও ধর্মীয় সংলাপ প্রচেষ্টার প্রতীক, যা গুরু নানক দেব জি ও নোস্ত্রা এইতাতে’র দর্শনের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।

প্রেরণার বার্তা:
ড. সুরিন্দর সিং কানধারি বলেন, “গুরু নানক দেব জি ও গুরু তেগ বহাদুর জির এই দুই পবিত্র দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যিকারের ধর্ম মানে হলো সেবা, আত্মত্যাগ ও সর্বজনীন সহমর্মিতা। তাঁদের শিক্ষা আমাদের একতা ও শান্তির পথে পরিচালিত করে।”
ড. বাবলস কানধারি যোগ করেন, “গুরু নানক ও গুরু তেগ বহাদুর জি আমাদের শেখান যে বিশ্বাসের মূল হলো কার্যকরী সহানুভূতি। গুরুদ্বারা গুরু নানক দরবারে আমরা প্রতিদিন তাঁদের শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করি সেবা, বিনয় ও মানবপ্রেমের মাধ্যমে।”
গুরুদ্বারা গুরু নানক দরবার দুবাই আজ শুধু এক ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি মানবতার এক আলোকস্তম্ভ। আধ্যাত্মিক সঙ্গীত, বিনয় ও সেবার মধ্য দিয়ে এটি বিশ্বকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়— সত্যিকারের বিশ্বাস তখনই দীপ্ত হয়, যখন তা সকল মানুষের ঐক্য ও মঙ্গলের জন্য নিবেদিত হয়।
#দুবাই #গুরুদ্বারা_গুরু_নানক_দরবার #গুরুপুরব #ভ্যাটিকান #শিখধর্ম #নোস্ত্রা_এইতাতে #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















