নতুন তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,০৪,৪৮৭ মিলিয়ন ডলারে। আগের বছর এটি ছিল ১,০১,৩৭১ মিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ডেট রিপোর্ট ২০২৫ বলছে, নতুন ঋণ বিতরণ কমে গেলেও সুদের বাড়তি ব্যয় ঋণের মোট পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
নেট ঋণপ্রবাহ ৫,৭৬৯ মিলিয়ন ডলার হলেও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণ ২০২৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১১,০৯৯ মিলিয়ন ডলারে, যা ২০২৩ সালে ছিল ১২,৮৪৪ মিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কঠিন হওয়ায় নতুন অর্থায়ন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ প্রদানে বড় ধরনের বৃদ্ধি দেখা গেছে। ২০২৩ সালের ১,৭২১ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে তা হয়েছে ২,৪৪৩ মিলিয়ন ডলার। সরকারি ও সরকারি নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ পরিশোধও বেড়ে পৌঁছেছে ১,৮৯৯ মিলিয়ন ডলারে। এই বৃদ্ধি ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে আরও বড় পরিশোধচাপের মুখে ফেলতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি ঋণের বড় অংশই এসেছে বহুপাক্ষিক (৫৫ শতাংশ) ও দ্বিপাক্ষিক (৩৭ শতাংশ) উৎস থেকে। অর্থাৎ সরকারি ঋণদাতাদের ওপরই নির্ভরতা অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বাংলাদেশ বছরজুড়ে আইবিআরডি-আইডিএ মিলিত অর্থায়নের অন্যতম বড় গ্রহীতা ছিল।
দক্ষিণ এশিয়ায় ঋণের দ্রুত বৃদ্ধি
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মোট বৈদেশিক ঋণ ২০২৪ সালে ৮.৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯৬ বিলিয়ন ডলারে। এই অঞ্চলে সরকারি ও সরকারি নিশ্চয়তাপ্রাপ্ত ঋণের সুদ পরিশোধের গতি দ্রুততম। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এ বৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি।
বাংলাদেশ একাই আইডিএ-যোগ্য ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ বহন করছে। নাইজেরিয়া ও পাকিস্তানের সঙ্গে দেশটি রয়েছে শীর্ষ সাত আইডিএ ঋণগ্রহীতার তালিকায়।

দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ-টু-জিএনআই অনুপাত ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে। নেপালে ২৩ শতাংশ এবং ভারতে ১৯ শতাংশ। মালদ্বীপে এ অনুপাত ৭৬ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কায় ৫৯ শতাংশ—যা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
ঋণ পরিষেবা-টু-রপ্তানি অনুপাত বাংলাদেশের ১৬ শতাংশ, ভারতে ১০ শতাংশ, নেপালে ১২ শতাংশ। তবে শ্রীলঙ্কায় এই অনুপাত ২৪ শতাংশ ও পাকিস্তানে ৪০ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক বলছে, আইডিএ-যোগ্য অর্থনীতিতে সরকারি ঋণদাতাদের ওপর নির্ভরতা সাধারণ বিষয়। নেপালে এই হার ৯০ শতাংশ, ভুটানে ৯৮ শতাংশ। বিপরীতে ভারত তার দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের ৭৭.৩ শতাংশই পায় বেসরকারি ঋণদাতাদের কাছ থেকে, যা তার বৈশ্বিক আর্থিক বাজারে প্রবেশাধিকারের ইঙ্গিত দেয়।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা: ঋণের ঝুঁকি বাড়ছে
ঢাকার এক অনুষ্ঠানে সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান সতর্ক করে বলেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশ ঋণ–ফাঁদে পড়তে পারে।
তিনি বলেন, রাজস্ব ঘাটতি, ঋণ পরিশোধের চাপ ও নীতিগত দুর্বলতার কারণে দেশ ঝুঁকিপূর্ণ পথে হাঁটছে। ২০১৫ সালে রাজস্ব-টু-জিডিপি অনুপাত ছিল ১০.৯ শতাংশ, যা কমে এখন ৭.৭ শতাংশ।
তিনি কর ব্যবস্থার অদক্ষতার বিষয়েও কঠোর সমালোচনা করেন। তার ভাষায়, চার লাখ পয়েন্টে ভ্যাট পরিশোধ করা হলেও সরকারি কোষাগারে আসে মাত্র ২৪ হাজার পয়েন্ট থেকে—যা দুর্নীতির স্পষ্ট ইঙ্গিত।
তিনি আরও বলেন, আয় ও ব্যয়ের তথ্য সমন্বয় না করলে কর ফাঁকি রোধ করা যাবে না। ইতিমধ্যে রাজস্ব বাজেটে সুদ প্রদানের খাত দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যয়ে পরিণত হয়েছে, যা কৃষি ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতকে পিছিয়ে দিচ্ছে। এই প্রবণতা চলতে থাকলে দেশ ঋণ–ফাঁদে পড়তে পারে।
এনবিআর চেয়ারম্যানের স্বীকারোক্তি
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ঋণ–ফাঁদে রয়েছে। তার মতে, বাস্তবতা অস্বীকার করে সামনে এগোনো সম্ভব নয়। কয়েক বছর আগেও কর-টু-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের ওপরে ছিল, এখন তা ৭ শতাংশের কাছাকাছি। জিডিপির বড় অংশই কর হিসেবে সরকারি কোষাগারে আসছে না।
বাংলাদেশ অর্থনীতি বৈদেশিকঋণ বিশ্বব্যাংক ঋণসংকট রাজস্বঘাটতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















