শশাঙ্ক মণ্ডল
নদনদী পরিবহণ যোগাযোগ
দ্বিতীয় অধ্যায়
সুন্দরবনের বিভিন্নপ্রান্তে আবিষ্কৃত নানা ধরনের প্রত্নসামগ্রী আমাদের স্মরণ করায় অতীতের সমৃদ্ধ জনপদের স্মৃতি। এই সব সমৃদ্ধ জনপদগুলির ইতিহাস নদীগুলির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সুন্দরবনের ইতিহাস নদীগুলিকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। বাংলার ইতিহাস রচনায়ও নদীগুলি তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে – সেই সাথে প্রতিনিয়ত বাংলার আকৃতিপ্রকৃতি নির্ধারণে সাহায্য করে চলেছে। বাঙলার ইতিহাসে- রাজনৈতিক ক্ষমতা ও শিল্প-বাণিজ্যের কেন্দ্রগুলি বারবার পরিবর্তিত হয়েছে এবং পরিবর্তনের পিছনে সব সময় নদীর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। নদীগুলি কখনও আশীর্বাদ আবার কখনও বা অভিশাপ নিয়ে এসেছে। নদীগুলি উত্তরে উচ্চ-ভূমি থেকে প্রতিনিয়ত পলল বহন করে ‘ব’-দ্বীপ-এর নিম্নভূমি গঠন করেছে এবং এখনও গড়ার কাজে সমানভাবে সক্রিয় রয়েছে।
নদীমাতৃক বাংলার দক্ষিণে আজকের ২৪ পরগণা, বাংলাদেশের যশোর-খুলনা-বরিশাল নিয়ে পূর্বপশ্চিমে ১৬০ মাইল প্রশস্ত ভূ-খণ্ডের পশ্চিমপ্রান্তে হুগলী নদী আর পূর্বে মেঘনা; এরই মধ্যবর্তীস্থলে অসংখ্য নদনদী ঘেরা সুন্দরবন অতীতের আঠারো বা বারোভাটির দেশ হিসাবে পরিগণিত হত। দীর্ঘকাল ধরে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের জলধারা নানাভাবে বিভক্ত হয়ে ভূমি গঠন করতে করতে সমুদ্রের সীমাকে সঙ্কুচিত করে নতুন নতুন উপদ্বীপ গঠন করেছে। ভূমি ক্রমশ দক্ষিণে নিচু হতে হতে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। অসংখ্য নদী প্রতিনিয়ত খাদ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক নদী আরেক নদীর সাঙ্গে মিশে নতুন নামে পরিচিত হচ্ছে। শুধু ভাঙা-গড়ার খেলা। দিক-চিহ্নহীন বিশাল জলধারা নিয়ে যে নদী বয়ে চলেছে, দেখা গেল কয়েকদশক পরে তার কোন চিহ্ন নেই। অসংখ্য নদী মাকড়সার জালের মতো স্থলভূমিকে জড়িয়ে ধরেছে এবং সমগ্র সুন্দরবনের ১৫ শতাংশ এলাকা নিয়ে এই সব নদীগুলির অবস্থান।
উনিশ শতকের শুরুতে তৎকালীন আমাদের দেশের শাসক ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি সুন্দরবনের বনাঞ্চল উঠিত করার দিকে নজর দিলেন। এর পিছনে কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে কোম্পানির লক্ষ্য ছিল রাজস্ব সংগ্রহ আর সেই সাঙ্গে আমাদের দেশের কিছু মানুষকে জমিদারিতে লাগিয়ে দিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করা। বনাঞ্চল উঠিত করার প্রয়োজনে নদীতীরে বাঁধ দিতে হল কারণ তখনও জমি খুবই নিচু, চাষ করার পক্ষে উপযুক্ত ছিল না। জোয়ারের জল নদীতে উপছে পড়ত। এই বাঁধের ফলে পলি নদীর বুকে জমতে লাগল।
নদীতীরবর্তী এলাকাগুলিতে এই পলি পৌঁছে দেবার সুযোগ রইল না – ফলে নদীর গভীরতা হ্রাস পেল। মোহনা-মুখে এই পলি জমা হতে লাগল, এর সাঙ্গে পরবর্তীকালে রেললাইন তৈরি, ব্রীজের জন্য নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ এবং আরও অনেক অবৈজ্ঞানিক নদী-পরিকল্পনার ফলে সুন্দরবন অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার বিভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে বিকৃতি দেখা দিতে শুরু করল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি সিলেক্ট কমিটির কাছে আর্থার কটন এ ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে বিখ্যাত নদী- বিজ্ঞানী উইলিয়াম উইলকক্স কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তৃতায় নদী-স্বাস্থ্যহানিকর রেলপথ এবং বাঁধের বেড়াজালের নামকরণ করেছিলেন ‘শয়তানের বেড়াজাল।’
Leave a Reply