সাইফুল হক
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুরা মিলে প্রায়ই গ্যালারিতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমরা নানা রকম আইডিয়া নিয়ে আলোচনা করতাম। মনে হতো, আমাদের হাতের মুঠোয় পুরো পৃথিবী। কখনও টেক স্টার্টআপ শুরু করার চিন্তা, আবার কখনও এমন একটা অ্যাপ বানানোর আইডিয়া আসতো, যা ঢাকার ভয়াবহ ট্রাফিক কমিয়ে দেবে। আমাদের মাথায় যেন একের পর এক আইডিয়া আসতেই থাকতো। আমরা অনেক সময় যুব ফোরামে গিয়ে নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করতাম, বিশ্বাস করতাম এই আইডিয়াগুলো যদি বাস্তবায়িত হয়, সমাজ বদলে যাবে।
আইডিয়া ঝড়ের মজা
পেছন ফিরে তাকালে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো ছিল চা, ফাস্ট ফুড আর ক্যাফেইনের নেশায় ভরা সৃজনশীলতার সময়। কল্পনায় কোনো সীমা ছিল না। আমি রাতভর আলাপের কথা মনে করি, যেখানে আমরা ব্যবসার পরিকল্পনা, টেকনোলজি নিয়ে নতুন উদ্ভাবনের কথা ভাবতাম, কিংবা সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করতাম। আমরা সবকিছুকে আরও ভালো করার স্বপ্ন দেখতাম!
যখন আমরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রনের আইডিয়া করি- তখন স্কেচ এঁকে, ফিচার ডিজাইন করে, কীভাবে একটি অ্যাপ সহজে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে উত্তেজনা কমতে লাগলো। বুঝলাম, অ্যাপটা বানানোর জন্য আমাদের নিজেদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ছিল না। আর অ্যাপ বানানোর জন্য কারো সাহায্য নিতে হলে টাকা দরকার, সেটাও আমাদের ছিল না। যত দিন গড়াচ্ছিল, আমরা পুরো প্রকল্পটার ব্যাপ্তি দেখে ভড়কে যাচ্ছিলাম, কারণ টেক ইন্ডাস্ট্রি কিংবা সামাজিক সচেতনতা নিয়ে কাজ করা গ্রুপগুলো শুধু সামান্য সাহায্য করতে রাজি হচ্ছিল। শেষমেশ, আইডিয়াটা ছেড়ে দিতে হলো।
আইডিয়া শুধু শুরু
আইডিয়া করার উত্তেজনা একধরনের নেশার মতো। কারণ তখন কোনো বাধা থাকে না—না কোনো ডেডলাইন, না বাজেট, না অন্য কোনো সীমাবদ্ধতা। তখন সবকিছু সম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু সেই প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেলে, আসল প্রশ্নটা আসে: এটা বাস্তবায়ন করবো কীভাবে?
তখনই সামনে আসে বাস্তবতা। মানুষ ঠিক যেমনটা ভাবা হয়, তেমনটা আচরণ করে না। আমাদের ট্রাফিক অ্যাপের কথা যখন প্রথম ভাবছিলাম, আমরা কখনও ভাবিনি যে মানুষ তাদের রুটিন পরিবর্তন করতে চাইবে না, এমনকি কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর সুযোগ থাকলেও। মানুষের আচরণের জটিলতা এবং বাস্তব জীবনে এসব আইডিয়া বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের ক্লান্ত করে তুলেছিল। শেষমেশ প্রজেক্টটি বন্ধ করার আগে আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, “আমি কেন এটা করছি?” আইডিয়া করার সময় যে উত্তেজনা ছিল, তা ম্লান হয়ে গিয়েছিল, তার জায়গায় ক্লান্তি, হতাশা আর বৈঠক, খাবার আর যাতায়াতের খরচ যোগ হয়ে গিয়েছিল।
বাস্তবতা ও অর্থের চিন্তা
আরও একটা কঠিন বাস্তবতা সামনে এলো, যখন বুঝতে পারলাম যে বেঁচে থাকার জন্য টাকা আয় করাটা তাত্ক্ষণিক প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতই আমি চাইতাম আমার আইডিয়া দিয়ে বিশ্ব বদলে দিতে, তার পাশাপাশি আমাকে নিজের খরচ চালাতে আর পরিবারের জন্য কিছু করতে হবে। তখনই দেখলাম, আমার কিছু বন্ধু টেলিকম কোম্পানি আর ব্যাংকে ভালো চাকরি করে টাকা আয় করছে। তারা দ্রুত কর্পোরেট সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল, আর অবশ্যই অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হতো—ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত—কিন্তু তারা অর্থ আয় করছিল। আর আমি চেষ্টা করছিলাম আমার আবেগের প্রজেক্ট আর সাইড গিগগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে, যেখানে তারা স্থিতিশীল বেতনে ভালোভাবে চলছিল। তাদের এই আর্থিক অগ্রগতি দেখে হিংসা হওয়া স্বাভাবিক ছিল।
আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়, যখন আমি প্রথম চাকরিতে যোগ দিই। আমি এক ছোট মার্কেটিং স্টার্টআপে কাজ শুরু করি, যেখানে আমার কাজ ছিল ব্যবসার স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা। প্রথম দিনই আমার অনেক উৎসাহব্যঞ্জক আইডিয়া ছিল, কিন্তু মিটিং শেষ হওয়ার পর কঠিন কাজ শুরু হতো—আমাদের সীমিত রিসোর্স দিয়ে কীভাবে আইডিয়াগুলো বাস্তবায়ন করবো সেটা বের করতে হতো। প্রথম দিন থেকেই আমার বস বলেছিলেন, “আইডিয়া দুর্দান্ত, কিন্তু ব্যবসার জন্য বাস্তবায়নই আসল।”
বাস্তবতার সাথে মানিয়ে চলা
এই অভিজ্ঞতা থেকেই শিখলাম আদর্শবাদ আর বাস্তবতার মধ্যে একটা ভারসাম্য রাখতে হবে। এখনও আমি বড় আইডিয়া নিয়ে স্বপ্ন দেখি, কিন্তু এখন বাস্তবতার মাটিতে পা রেখে স্বপ্ন দেখি। শুধু বিশ্বকে বদলানোর ইচ্ছা থাকলেই হবে না—কীভাবে সেটা করবো আর নিজের অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাবো, সেটাও ভাবতে হবে।
তাই, যদি আপনি আমার মতো হন—বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নতুন গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরিয়ে আসা, মাথা ভরা আইডিয়া—তাহলে মনে রাখবেন: আইডিয়া করা শুধু শুরু। আসল কাজ শুরু হয়, যখন আপনি হাতা গুটিয়ে কাজ শুরু করেন। আইডিয়া বাস্তবে রূপ দিতে গেলে অনেক বিরক্তিকর কাজ, বাধা আর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হবে। তবুও, এই চেষ্টাগুলো মূল্যবান। কারণ দিন শেষে, আইডিয়া তখনই মূল্যবান হয়, যখন তা বাস্তবায়িত হয়।