হেনি সেন্ডার
গত বসন্তে চীনের হাংঝৌতে পিপলস ব্যাংক অব চায়নার একটি সম্মেলন হয়েছিল, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক কাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৮০ বছর আগে অনুষ্ঠিত ব্রেটন উডস সম্মেলনের বার্ষিকী স্মরণ করা হচ্ছিল। কিন্তু এটি আসলে কোনো আনন্দোৎসব ছিল না।
টেক্সাসে পড়াশোনা করা পিপলস ব্যাংক অব চায়নার নতুন ডেপুটি গভর্নর জুয়ান চ্যাংনেং-এর মতো কর্মকর্তারা বলছেন যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো খুব অল্প কিছু পশ্চিমা দেশের স্বার্থকেই প্রতিনিধিত্ব করে। প্রকৃতপক্ষে গ্লোবাল সাউথ এখন বিশ্বজুড়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অর্ধেকেরও বেশি প্রতিনিধিত্ব করে, অথচ তাদের ভোটাধিকার এমনভাবে বণ্টিত নয়। এই বৈষম্য নিয়ে চীন যথার্থভাবেই অসন্তোষ জানাচ্ছে।
অন্যদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর পশ্চিমা বিশ্বের ওপর সমালোচনা করে বলেছেন, শুধু উন্নত দেশগুলোরাই গণতান্ত্রিক হতে পারে—এই ধারণা যেমন ভুল, তেমনি পশ্চিমের সংকীর্ণ স্বার্থবিশেষকে বিশ্বময় প্রাধান্য দেওয়াও ঠিক নয়। উন্নয়নশীল দেশের জরুরি বিষয়গুলো বরং পেছনে পড়ে যাচ্ছে। এসব কথা অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশগুলোর মনোভাবের সাথেও মিলে যায়।
এই দুই এশীয় পরাশক্তি এখন গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তারা ভিন্ন ভিন্ন সাফল্যের দিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের পথ দেখালেও তাদের মধ্যে কিছু সাধারণ অভিমান আছে—যেমন কোভিড-১৯ মহামারির সময় কার্যকর এমআরএনএ টিকার অসম বণ্টন। তবু তাদের ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা।
চীনের উন্নয়ন মডেল অনেক বেশি আকর্ষণীয়। কোনো দেশ এত দ্রুত দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, যেভাবে চীন পেরেছে। ১৯৮০-এর দশক থেকে গ্রামের অনুৎপাদনশীল ক্ষুদ্র চাষবাস ছেড়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বড়ো অংশ শহুরে কলকারখানায় কাজ নিয়েছে। সেখানে তারা স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য তৈরির পাশাপাশি (যেখানে মাথাপিছু আয় এখন ১২,৫০০ ডলারের বেশি) সারা বিশ্বের জন্যও পণ্য তৈরি করে। ক্রমাগত উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদনে যুক্ত হওয়ার ফলে সারা বিশ্বের ক্রেতারা স্বল্পমূল্যে ভালোমানের পণ্য পেতে চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চীনের বিশাল উৎপাদনক্ষমতার সাথে অন্য কোনো দেশ এখনো পাল্লা দিতে পারছে না।
তার ওপর ভবিষ্যতের প্রযুক্তি-নির্ভর পণ্য তৈরিতে এখনো চীনই এগিয়ে। যদি ধীরে ধীরে প্রচলিত যানবাহন অচল হয়ে পড়ে (সময়সীমা অনিশ্চিত হলেও), তাহলে বৈদ্যুতিক যানবাহনের মূল উপাদান ব্যাটারি তৈরির প্রযুক্তি চীনের কাছেই রয়েছে। ফলে তারা সহজেই অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিনের প্রযুক্তি পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারবে।
যদিও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির গতি ধীর হতে পারে, তবুও চীনের শিল্পভিত্তিক অর্থনৈতিক মডেল এখনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সবচেয়ে কার্যকর অবকাঠামো হয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় নিয়োগদাতা হলো সিউল-ভিত্তিক ইয়ংওয়ান, যেখানে সত্তর হাজারের বেশি কর্মী পাটাগোনিয়া এবং দ্য নর্থ ফেস-এর মতো ব্র্যান্ডের জন্য তাদের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে উচ্চমূল্যের শীতপোশাক তৈরি করে। কিন্তু তাদের পরের প্রজন্মের লক্ষ্য ডাক্তার হওয়ার দিকে ঝুকেছে। ইয়ংওয়ান ও অনুরূপ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যই বিশ্বব্যাংক মনে করে বাংলাদেশ শিগগির মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে।
অন্যদিকে ভারত তার অর্থনীতিকে পরিষেবা খাতে গড়ে তুলেছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, কিন্তু একইসঙ্গে কর্মসংস্থান কমিয়ে দেয়। তাই এখন ভারতে শিল্পভিত্তিক বিশাল কারখানা তৈরির সুযোগ অনেকাংশে ফসকে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ফক্সকন চীনে যেমন তিন লক্ষ কর্মী সমৃদ্ধ কারখানা গড়েছিল, ভারতে আর সেভাবে হবে না। বর্তমানে উৎপাদনের স্কেল ও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে ভারত চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না, বিশেষত ভবিষ্যতের আধুনিক পণ্য তৈরিতে। আবার কিছু ক্ষেত্রে চেষ্টাই অপ্রয়োজনীয়; যেমন সৌর প্যানেল উৎপাদন শ্রমনির্ভর নয়, বরং মূলত মূলধন-নির্ভর। উচ্চ সুদহার ও ব্যয়বহুল মূলধনের কারণে ভারতের পক্ষে এগুলো তৈরিতে প্রতিযোগিতামূলক হওয়া কঠিন। বরং বিশাল বেকার ও স্বল্পদক্ষ জনবলকে কাজে লাগানোই ভারতের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
বিশ্ব হয়তো লক্ষ করেনি, কিন্তু অনেক ভারতীয়ই খেয়াল করেছেন যে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেকে এস. জয়শঙ্কর আসন নির্ধারণ না থাকা সত্ত্বেও ফার্স্ট-ক্লাস সিট দখল করেন এবং সেখান থেকে ওঠেননি। বিপরীতে, চীনের উপরাষ্ট্রপতিকে বসানো হয়েছিল পেছনের দিকে।
এছাড়া ভারতের আরেকটি বিশাল সুবিধা হলো বিশ্বের সামনে তারা ‘সফট পাওয়ার’ তুলে ধরতে পারে—যেমন বলিউডের সিনেমা ও সংগীত বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়।
অন্যদিকে চীন ‘সফট পাওয়ার’কে গুরুত্ব দেয় বলে মনে হয় না। সিনেমায় কঠোর সেন্সরশিপের কারণে যেকোনো নির্ভেজাল বার্তা বা জীবন্ত গল্প বিসর্জন যায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো স্থানীয় দর্শকদের কাছেও আবেদন হারায় (হয়তো আরও বেশি করে)। একজন শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের ভাষ্যমতে, সিনেমায় কোভিড-১৯ এর উল্লেখ থাকলেই সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মূলত চীনা চলচ্চিত্র যদি দেশের বাইরের দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হয়, তবে সেটা বিশেষ করে বাস্তবিক প্রয়োজনে বা কিছুটা স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে হতে পারে।
এর পাশাপাশি চীনের আত্ম-চেতনা ও বিশ্বের চীনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বিরাট ফাঁক রয়ে গেছে। চীনের নিজস্ব ধারণা হচ্ছে তারা এক অবরুদ্ধ জাতি, যাদের খাদ্য ও জ্বালানির স্বয়ংসম্পূর্ণতা নেই এবং একটি বৈরী বিশ্বের মধ্যে বাস করতে হয়। সত্যি বলতে, চীন এখন বোঝার চেষ্টা করছে যে বেশিরভাগ দেশ তাদের এভাবে দেখে না। বরং অন্যরা আশা করে চীন প্রতিবেশী যেমন ইন্দোনেশিয়াকে আরও সাহায্য করুক। কাঁচামাল ও পণ্য কেনার পর দেশে নিয়ে গিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে শুধু মূল্য সংযোজন করা নয়, সেই মূল্য সংযোজন আরও স্থানীয় পর্যায়ে করার চেষ্টা চালাচ্ছে চীন। তবু প্রতিবেশী দেশগুলো মনে করে চীন আরও বেশি কিছু করতে পারে।
ভারত এদিকে শ্রীলঙ্কার মতো ছোট প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক কিছুটা মেরামত শুরু করেছে মাত্র।
সর্বশেষে কথা হলো: বর্তমান বৈশ্বিক অস্থির ভূ-রাজনীতি ও বাড়তে থাকা রক্ষণশীল বাণিজ্যনীতির যুগে গ্লোবাল সাউথের জন্য ভারত বা চীন—এই দুই পরাশক্তির কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদে বড় সহায়তা আশা করা হয়তো অবাস্তব। আত্মনির্ভর হওয়াই এ অঞ্চলের জন্য বাস্তবসম্মত পথ।
লেখক: হেনি সেন্ডার অ্যাপসারা অ্যাডভাইসরি নামে একটি কৌশলগত পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা অংশীদার। তিনি আগেও ব্ল্যাকরক নামের একটি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।