আজ ৭ মার্চ। ১৯৭১ এর এ দিন আজ এমুহূর্তে বসে কোন মতেই উপলব্দি করা সম্ভব নয়। আজ আকাশের সূর্যটি অনেক প্রখর, সেদিন আকাশের সূর্য ছিলো বসন্তের সঙ্গে মিলিয়ে অনেক নরম রোদের, আর ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় ভরা ছিলো ঝরে পড়া পুরোনো পাতা। সূর্য যখন নরম হয়ে পৃথিবীকে ছায়াচ্ছন্ন করে তখন পৃথিবীও নারীর মতো তার গর্ভেও নতুন কিছু ধারণ করতে যায়। ৭ মার্চ, ১৯৭১ প্রকৃতি যেন সে ঈংগিতই দিয়েছিলো। আর ঝরা পাতায় ভরা ঢাকার রাস্তা জানিয়ে দিয়েছিলো, নতুন পাতা বৃন্তে সাজবে।
সত্যি সেদিন বাঙালি মায়ের গর্ভে জম্ম নিয়েছিলো “স্বাধীনতা” আর পুরানো পাতার বৃন্ত গুলো শুনেছিলো নতুন পাতার “ মুক্তি সংগ্রাম” এর আহবান।
বাঙালির ইতিহাসের সহস্র সহস্র বছর পরে বাংলার মাটি থেকে উত্থিত শালপ্রাংশু পুরুষ যাকে বলে, সেই দীর্ঘদেহী মানুষটি, যিনি শুধু শারিরিকভাবে দীর্ঘ ছিলেন না, মানুষের মুক্তির পথে দীর্ঘ সংগ্রাম পেরিয়ে, শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে বাঙালিকে “স্বাধীনতা” ও “মুক্তি” এ দুটি শব্দ শোনানোর শুধু নয়, সেই পথে বাঙালিকে পরিচালিত করার সকল নৈতিক ও আইনগত অধিকার নিয়ে- এই ৭ মার্চ তিনি উচ্চারণ করেছিলেন।
এই উচ্চারণ কোন আকস্মিক ঘটনা ছিলো না, ছিলো বাঙালির দীর্ঘ বাইশ বছরের সংগ্রামের ফসল। এই দীর্ঘ সংগ্রামের পথ বেয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের আহবান শোনানোর নৈতিক ও আইনগতভাবে মূল নেতা হয়ে উঠেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তার ভেতর দিয়েই মানুষ দেখেছিলো- একটি জাতি ও একটি মানচিত্রের জম্ম। এ কারনেই সেদিনের বিদগ্ধ তরুণ সমাজ প্রথমেই তাকে “ জাতির জনক” বলে অভিহিত করেছিলেন। ইতিহাসের বিচারেও এ সত্য অক্ষয় ও অব্যয়।
একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তি’র সংগ্রাম অনেক দীর্ঘ পথযাত্রা। মানচিত্র পেলেই পথযাত্রা শেষ হয়ে যায় না। কারণ, মানব সভ্যতার লক্ষ লক্ষ বছর পরিক্রমায় দেখা যায়, স্বাধীনতা মনোজাগতিক বিষয়। যতক্ষণ না একটি জাতির মন স্বাধীন হয় ততক্ষণ ওই জাতি স্বাধীনতার পূর্ণতার পথে হাঁটতে পারে না। আর এই মনোজাগতিক মুক্তি মানুষের তখনই আসে যখন প্রতিটি মানুষ চিন্তা ও বিশ্লেষণে সয়ম্ভূ হয়। মানব সভ্যতায় এ পথ অনেক দীর্ঘ। অনেক কন্টাকার্কীন। জঙ্গলে যেমন ভয়ংকর জন্তু ও দস্যু থাকে, সভ্যতার পথে ও মানুষের মনোগজতেও একই অবস্থা -সেখানেও জন্তু ও দস্যু বাস করে। মানুষকে তার আত্মশক্তি ও আত্মপ্রজ্ঞা দিয়ে বিজিত করতে হয় এই জন্তু ও দস্যুকে প্রতি মূহূর্তে- আর এটাই রবীন্দ্রনাথের সেই সত্য, “ তোমার গাছে গাছে প্রচ্ছন্ন রেখেছো প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম” । রবীন্দ্র নাথের রক্তকরবীর নন্দিনীর দৃষ্টিতে, শহরটা যেমন অন্ধকারে মাটির নিচে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে কেবল হাতড়ে বেড়াচ্ছিলো- মানব সভ্যতা বা মানব সভ্যতায় কোন কোন নরগোষ্টি এমনিভাবে কখনও কখনও মাটির নিচের অন্ধকারে মাথা ঢুকিয়ে দেয়। আর তখনই জেগে ওঠে সভ্যতার মূল সংগ্রামের সূত্র, তোমার গাছে গাছে প্রচ্ছন্ন রেখেছো প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম।
বাস্তবে মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম, সভ্যতার এক প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ৭ মার্চ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সেই সংগ্রাম শুরুর ঘোষণা দেন। তারপর রাজনৈতিক সংগ্রাম ও যুদ্ধের ভেতর দিয়ে মানচিত্র এসেছে – তবে মানুষের নিজ নিজ স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্যে তাকে প্রজম্ম থেকে প্রজম্ম নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হবে। আর সে পথে কখনও ক্ষীন আলো দেখা যাবে, কখনও নামবে গভীর অন্ধকার। তবু মনে রাখতে হবে পৃথিবীর শেষ সত্য, সংগ্রামের পথে মুক্তি।
আজ ৭ মার্চ। জাতি আপন মনোভূবনে বসে স্মরণ করুক তার মুক্তি ও স্বাধীনতার সেই বজ্র ঘোষণার আনুষ্ঠানিক দিনটিকে।