০৬:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৫২)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫
  • 30

সেবা-সমিতির সভ্য হিসাবে

ইতিমধ্যে রেলস্টেশনের কুলিদের দুই-তিনজনের কলেরা হইল। আমি রাতের মতো স্টেশন-মাস্টারের ঘরে থাকি আর প্রতি তিন ঘণ্টা অন্তর রোগীদের মধ্যে যাইয়া তাহাদের দেহে পার-রেকটাল সেলাইন-পানি প্রবেশ করাই। বহু অভিজ্ঞতায় আমার ধারণা হইয়াছিল, রক্তনালি দিয়া সেলাইন-পানি রোগীর দেহে প্রবেশ করাইয়া ডাক্তারেরা যেসব রাজসিক ইন্তেজাম করেন তাহা দেখিয়া অধিকাংশ অশিক্ষিত রোগীই হার্টফেল করিয়া মারা যায়। তাই পারতপক্ষে আমি কোনো অশিক্ষিত রোগীর রক্তনালিতে নুন-পানি প্রবেশ করানো অনুমোদন করিতাম না। আর করিলেই বা কি হইত? এইসব গরিব রোগীর পক্ষে ডাক্তারের চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা ফি ও ঔষধ কেনার পয়সা জোটানো অসম্ভব ছিল। তখন আমার কিইবা বয়স।

মাত্র পনরো বৎসরের বেশি হইবে না। আজ ভাবিয়া আশ্চর্য হই, সেই ছোট্ট ছেলেটি কি করিয়া সারারাত ভরিয়া এ-বস্তি সে-বস্তি ঘুরিয়া এতগুলি রোগীর দেখাশুনা করিত। আমার মনে পড়িতেছে, গভীর রাত্রকালে হাতের ডুসটি লইয়া কুলি-ব্যারাকের দিকে চলিয়াছি। বেশ ভয় ভয় করিতেছে। কিন্তু আমার মনে হইতেছে, আমার ভিতরে যেন কে আর একজন জাগিয়া উঠিয়াছে। এই রাতের নির্জনতায় সে আমাকে দিয়া তার নির্দিষ্ট পাঠটি নিখুঁতভাবে করাইয়া লইতেছে। সকাল হইলে গাঁয়ের লোকেরা আমাকে দেখিয়া ধন্য ধন্য করিত। সেইসব প্রশংসাবাণী আমাকে যেন অপর একজন করিয়া দিত। কুলিরা তখন এখানে-ওখানে নানা দলে বাস করিত। তাই সব রোগীদের দেখিতে দেখিতে কোথা দিয়া যে রাত্র কাটিয়া যাইত টেরও পাইতাম না। এরই মধ্যে নিয়ম অনুসারে সেই বউটিকেও দেখিতে যাইতাম। এবার বউটি জ্ঞান হারাইয়াছে। হাত-পা ঠাণ্ডা। নাড়ি চলিতেছে না।

কলেরা রোগী ঘণ্টায় ঘণ্টায় অবস্থা পরিবর্তন করে। এই নাড়ি চলিতেছে, এই চলিতেছে না। সেইজন্য কলেরা রোগীকে দেখিয়া কেহ আশাবাদীও হইবে না আবার নিরাশও হইবে না। কিন্তু মেয়েটির চোখ উল্টাইয়া গিয়াছে। চোখের মণিতে রক্ত উঠিয়াছে। তাহাতেই কিছুটা শঙ্কিত হইলাম। স্বামীটিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার শাশুড়ি কি সত্যই আসিল না?” সে বলিল, “কাল লোক পাঠাইয়াছিলাম, সে আসিল না।” পাড়ার সকল লোকে একত্র হইলেই এই বউটির পয়েন্টম্যান-স্বামীর প্রশংসা করে। তাহারা বলাবলি করে, কলিযুগে এমন কর্তব্যপরায়ণ স্বামী কোথাও দেখা যায় না। দেখ না বউটিকে কিভাবে সেবা করিতেছে।

অনবরত ছয়-সাতদিন কলেরা রোগীর সঙ্গে সমানে রাত্র জাগিয়া আমি বড়ই ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম। ইতিমধ্যে একজন কুলি মারা গেল। শহরে ভীষণ কলেরা আরম্ভ করিল। আমার বাড়ির ধারে শ্মশানঘাট। সেখানে একসঙ্গে তিন-চারটি চিতা জ্বলিতে লাগিল। এইসব কারণে আমি আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া পড়িলাম। শ্মশানঘাটে হিন্দু শবযাত্রীদের হরিবোল শব্দ শুনিয়া আমার বুকের মধ্যে ধড়ফড় করিয়া উঠে। ঘুমে চক্ষু বুজিয়া আসে। কিন্তু আধঘুমে নানা বিভীষিকা দেখিয়া ঘুমাইতে পারি না। আমার পিতা-মাতা আমার জন্য শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন।

পাঁচ-ছয়দিন পরে আমি কিছুটা ভালো হইয়া উঠিলাম। স্টেশনে আসিয়া স্টেশন-মাস্টার উমাকান্তবাবুকে বউটির কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন, “গতরাত্রে বউটি মারা গিয়াছে।” শুনিয়া বড়ই খারাপ লাগিল, আহা স্বামী বেচারার অবস্থা যেন কেমন হইয়াছে। সে হয়তো বউ-এর মৃত্যুতে পাগল হইয়া ঘুরিতেছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “বউটির স্বামী এখন কোথায়?”

স্টেশন-মাস্টার কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, “সেই পাষণ্ডের কথা আর বলিও না। তুমি যাওয়ার পর সে আর একদিনও বউ-এর পাশে বসে নাই। বউটিকে ঘরে তালাবন্ধ করিয়া আসিয়া সে বস্তির কুলিদের সঙ্গে মিলিয়া গাঁজা খাইত। একদিন ঘরে যাইয়া দেখে বউটি মরিয়া রহিয়াছে।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে এখন কোথায়?” মাস্টারবাবু বিরক্তির সঙ্গে বলিলেন, “কি জানি কোথায়? হয়তো বন্ধুজনকে সঙ্গে লইয়া কোথাও গাঁজা খাইতেছে।” শুনিয়া আমি শিহরিয়া উঠিলাম। আমাদের সকল ভালোবাসারই পরিণতি কি এইভাবে হয়।

চলবে…..

 

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৫২)

১১:০০:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫

সেবা-সমিতির সভ্য হিসাবে

ইতিমধ্যে রেলস্টেশনের কুলিদের দুই-তিনজনের কলেরা হইল। আমি রাতের মতো স্টেশন-মাস্টারের ঘরে থাকি আর প্রতি তিন ঘণ্টা অন্তর রোগীদের মধ্যে যাইয়া তাহাদের দেহে পার-রেকটাল সেলাইন-পানি প্রবেশ করাই। বহু অভিজ্ঞতায় আমার ধারণা হইয়াছিল, রক্তনালি দিয়া সেলাইন-পানি রোগীর দেহে প্রবেশ করাইয়া ডাক্তারেরা যেসব রাজসিক ইন্তেজাম করেন তাহা দেখিয়া অধিকাংশ অশিক্ষিত রোগীই হার্টফেল করিয়া মারা যায়। তাই পারতপক্ষে আমি কোনো অশিক্ষিত রোগীর রক্তনালিতে নুন-পানি প্রবেশ করানো অনুমোদন করিতাম না। আর করিলেই বা কি হইত? এইসব গরিব রোগীর পক্ষে ডাক্তারের চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা ফি ও ঔষধ কেনার পয়সা জোটানো অসম্ভব ছিল। তখন আমার কিইবা বয়স।

মাত্র পনরো বৎসরের বেশি হইবে না। আজ ভাবিয়া আশ্চর্য হই, সেই ছোট্ট ছেলেটি কি করিয়া সারারাত ভরিয়া এ-বস্তি সে-বস্তি ঘুরিয়া এতগুলি রোগীর দেখাশুনা করিত। আমার মনে পড়িতেছে, গভীর রাত্রকালে হাতের ডুসটি লইয়া কুলি-ব্যারাকের দিকে চলিয়াছি। বেশ ভয় ভয় করিতেছে। কিন্তু আমার মনে হইতেছে, আমার ভিতরে যেন কে আর একজন জাগিয়া উঠিয়াছে। এই রাতের নির্জনতায় সে আমাকে দিয়া তার নির্দিষ্ট পাঠটি নিখুঁতভাবে করাইয়া লইতেছে। সকাল হইলে গাঁয়ের লোকেরা আমাকে দেখিয়া ধন্য ধন্য করিত। সেইসব প্রশংসাবাণী আমাকে যেন অপর একজন করিয়া দিত। কুলিরা তখন এখানে-ওখানে নানা দলে বাস করিত। তাই সব রোগীদের দেখিতে দেখিতে কোথা দিয়া যে রাত্র কাটিয়া যাইত টেরও পাইতাম না। এরই মধ্যে নিয়ম অনুসারে সেই বউটিকেও দেখিতে যাইতাম। এবার বউটি জ্ঞান হারাইয়াছে। হাত-পা ঠাণ্ডা। নাড়ি চলিতেছে না।

কলেরা রোগী ঘণ্টায় ঘণ্টায় অবস্থা পরিবর্তন করে। এই নাড়ি চলিতেছে, এই চলিতেছে না। সেইজন্য কলেরা রোগীকে দেখিয়া কেহ আশাবাদীও হইবে না আবার নিরাশও হইবে না। কিন্তু মেয়েটির চোখ উল্টাইয়া গিয়াছে। চোখের মণিতে রক্ত উঠিয়াছে। তাহাতেই কিছুটা শঙ্কিত হইলাম। স্বামীটিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার শাশুড়ি কি সত্যই আসিল না?” সে বলিল, “কাল লোক পাঠাইয়াছিলাম, সে আসিল না।” পাড়ার সকল লোকে একত্র হইলেই এই বউটির পয়েন্টম্যান-স্বামীর প্রশংসা করে। তাহারা বলাবলি করে, কলিযুগে এমন কর্তব্যপরায়ণ স্বামী কোথাও দেখা যায় না। দেখ না বউটিকে কিভাবে সেবা করিতেছে।

অনবরত ছয়-সাতদিন কলেরা রোগীর সঙ্গে সমানে রাত্র জাগিয়া আমি বড়ই ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম। ইতিমধ্যে একজন কুলি মারা গেল। শহরে ভীষণ কলেরা আরম্ভ করিল। আমার বাড়ির ধারে শ্মশানঘাট। সেখানে একসঙ্গে তিন-চারটি চিতা জ্বলিতে লাগিল। এইসব কারণে আমি আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া পড়িলাম। শ্মশানঘাটে হিন্দু শবযাত্রীদের হরিবোল শব্দ শুনিয়া আমার বুকের মধ্যে ধড়ফড় করিয়া উঠে। ঘুমে চক্ষু বুজিয়া আসে। কিন্তু আধঘুমে নানা বিভীষিকা দেখিয়া ঘুমাইতে পারি না। আমার পিতা-মাতা আমার জন্য শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন।

পাঁচ-ছয়দিন পরে আমি কিছুটা ভালো হইয়া উঠিলাম। স্টেশনে আসিয়া স্টেশন-মাস্টার উমাকান্তবাবুকে বউটির কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন, “গতরাত্রে বউটি মারা গিয়াছে।” শুনিয়া বড়ই খারাপ লাগিল, আহা স্বামী বেচারার অবস্থা যেন কেমন হইয়াছে। সে হয়তো বউ-এর মৃত্যুতে পাগল হইয়া ঘুরিতেছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “বউটির স্বামী এখন কোথায়?”

স্টেশন-মাস্টার কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, “সেই পাষণ্ডের কথা আর বলিও না। তুমি যাওয়ার পর সে আর একদিনও বউ-এর পাশে বসে নাই। বউটিকে ঘরে তালাবন্ধ করিয়া আসিয়া সে বস্তির কুলিদের সঙ্গে মিলিয়া গাঁজা খাইত। একদিন ঘরে যাইয়া দেখে বউটি মরিয়া রহিয়াছে।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে এখন কোথায়?” মাস্টারবাবু বিরক্তির সঙ্গে বলিলেন, “কি জানি কোথায়? হয়তো বন্ধুজনকে সঙ্গে লইয়া কোথাও গাঁজা খাইতেছে।” শুনিয়া আমি শিহরিয়া উঠিলাম। আমাদের সকল ভালোবাসারই পরিণতি কি এইভাবে হয়।

চলবে…..