সেবা-সমিতির সভ্য হিসাবে
তিন-চারদিন রোগীর প্রস্রাব হয় না। রোগীর প্রস্রাব আনার কায়দাও আমি জানি। ছোট ছোট তিন-চারটি গ্লাসের মধ্যে সামান্য স্পিরিট ঢালিয়া আগুন জ্বালাইয়া দিলাম। সেই আগুন-সমেত গ্লাসটি রোগীর মাজার দুই পাশে লাগাইতে লাগিলাম। সকালে এরূপভাবে বহুক্ষণ চেষ্টা করিয়াও রোগীর প্রস্রাব হইল না। কিন্তু বিকালে দুই-তিনবার চেষ্টা করিতেই রোগী প্রসাব করিল। ভুসীকে বলিলাম, “ভুসী! এবার তোমার ছেলের আর কোনো ভয় নাই। শিগগির ভালো হইয়া যাইবে।” হইলও তাই। কয়েকদিনের মধ্যেই ভুসীর ছেলে ভালো হইয়া গেল। স্টেশনের কুলিমহলে ‘দাগদার বাবু’ বলিয়া আমার নাম রটিল। হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারেরা কিন্তু ইহাতে খুশি হইলেন না। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় যদি ভুসীর ছেলে মারা যাইত, তাহারা বলিত, ‘দেখ! হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করিলে এই ছেলে মারা যাইত না।’
এই সুযোগ তাঁহারা শীঘ্রই পাইলেন। গ্রামের ছবু শেখের ছোট চার বৎসরের মেয়েটির কলেরা হইল। খবর পাইয়াই অমিয়বাবু ডাক্তারকে সঙ্গে লইয়া মেয়েটিকে দেখিতে গেলাম। আহা। রাঙা টুকটুকে মেয়েটি। গরিবের ঘরে আসিয়া কোথা হইতে এই এক গা রূপ সে কুড়াইয়া আনিয়াছে। ডাক্তারের নির্দেশমতো আমি রোগীকে পার-রেকটাল সেলাইন দিতে লাগিলাম।
পরদিন দুপুরবেলা দেখি, মেয়েটির নাড়ি নাই। আমি তাহাকে সেলাইন দিতে আরম্ভকরিলাম। মা পাশে বসিয়া কত আশায় আমার দিকে চাহিয়া রহিল। আমার প্রত্যেকটি কাজ যেন তার বাছনিকে নিরাময় করিতেছে। হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া মেয়েটি মারা গেল। মা চিৎকার করিয়া আমার পায়ে আসিয়া পড়িল,-“ও জসী। কি করিলিরে। আমার বাছারে তুই মারিয়া ফেলিলি।” সেই মেয়ে-হারা মায়ের সঙ্গে কাঁদিতে কাঁদিতে আমি গৃহে ফিরিয়া আসিলাম। তখন আমারও মনে হইল, অসময়ে ডুস দিয়া আমিই মেয়েটিকে মারিয়া ফেলিলাম।
হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারেরা তাহাদের সমর্থকদের সাহায্যে পাড়ায় পাড়ায় রটাইয়া দিল, ‘কি চাও অমুক, ছবুর মেয়ের নাড়ির ভিতরে সেলাইন দিয়া তাহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে।’ যেখানেই যাই সেখানেই আমাকে লইয়া লোকে ছি ছি করে। এতদিন যে সেবা করিয়া এত রোগীকে ভালো করিয়াছিলাম সেকথা সকলেই ভুলিয়া গিয়াছে।
অমিয়বাবুর কাছে যাইয়া সমস্ত খুলিয়া বলিলাম। তিনি বলিলেন, “তোমার পার-রেকটাল সেলাইন দেওয়াতে রোগী কিছুতেই মরিতে পারে না। রোগী হয়তো তখনই মরিত। সেলাইন দিতে যাইয়া তুমি তাহাকে বাঁচাইতে গিয়াছিলে। এজন্য তাহাদের তোমাকে নিন্দা না করিয়া প্রশংসা করাই উচিত ছিল।”
কত সামান্য সামান্য অসুখে গ্রামদেশের লোকেরা মারা যায়! আমাদের গ্রামে একটি লোক খুব ভালো কেচ্ছা বলিতে পারিত। আমি মাঝে মাঝে যাইয়া তাহার নিকট কেচ্ছা শুনিতাম। সেবার শুনিতে পাইলাম, লোকটির ঘোরতর অসুখ। বাঁচিবার আশা নাই। আমাকে দেখিতে চাহিয়াছে।
সন্ধ্যার পরে আমি লোকটিকে দেখিতে গেলাম। যাইয়া দেখি, সে মরিয়া যাইবে মনে করিয়া তাহার গল্প শোনার অনুরাগীরা প্রত্যেকেই কিছু-না-কিছু আনিয়া তাহাকে খাইতে দিয়াছে। একজন আনিয়া দিয়াছে তেলে-ভাজা জিলাপি, অপরজন আনিয়াছে তেলে-ভাজা শক্ত গজা। সে শুইয়া শুইয়া একটু একটু করিয়া কামড়াইয়া খাইতেছে।
আমি তাহার হাত ধরিয়া দেখিলাম হাতের নাড়ি বসা। ঘন ঘন রক্ত-পায়খানা হইতেছে। মনে মনে ভাবিলাম, লোকটির রক্ত-আমাশা হইয়াছে।
আমাকে দেখিয়া সে বলিল, “আপনাদের কাছে কত কসুর করিয়াছি। আজ আমার শেষ দিন। সকল অপরাধ মাপ করিয়া দিবেন।”
আমি বলিলাম, “কে বলে যে তুমি মরিয়া যাইবে? কাল আমি শহর হইতে ডাক্তার আনিয়া তোমাকে ভালো করিয়া দিব।” আমার কথা শুনিয়া লোকটির কোটরাগত চক্ষু দুইটি বাঁচিবার আশায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
তখন আমি বলিলাম, “এইসব তেলে-ভাজা জিনিস যাহারা তোমাকে খাইতে দিয়াছে তাহারা মনের অগোচরে তোমার শত্রুতা করিতেছে। বিষের মতো এইসব ফেলিয়া দাও।”
সমবেত লোকদিগকে বলিলাম, “তোমরা তোমাদের পোঁটলা-পুঁটলি লইয়া যার যার বাড়ি চলিয়া যাও। এগুলি আমি কিছুতেই এই রক্ত-আমাশার রোগীকে খাইতে দিব না।” অনিচ্ছাসত্ত্বেও যার যার আনা খাবারের পোঁটলা-পুঁটলি লইয়া অনুরাগীরা ধীরে ধীরে সরিয়া পড়িল। পরদিন অমিয়বাবু ডাক্তারকে আনিয়া রোগী দেখাইলাম। তিনি একটি মিকচার লিখিয়া দিলেন আর দুই-তিনটি ইনজেকশনের ব্যবস্থা করিলেন। চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই লোকটি সারিয়া উঠিল। ইহার পর লোকটি আরও পোনরো ষোল বৎসর বাঁচিয়াছিল। তাহার কেচ্ছা-কাহিনীর আসরে আগের মতোই লোক জমা হইত। এই লোকটি যাকে দেখিত তাকেই বলিত, “অমুকের ছেলে অমুক আমাকে সেবার মৃত্যুর হাত হইতে বাঁচাইয়াছে।”
এরূপ কত দৃষ্টান্ত দিব। সামান্য একটু ঔষধ দিয়া বহু মৃত্যু-পথযাত্রী লোককে আমরা বাঁচাইয়াছি।
চলবে…..