ডাক্তার সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
ইহার আরও আগের ঘটনা। আমি তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র। ফরিদপুরে আসিলেন এক পাগলা ডাক্তার। যাকে দেখেন তারই সঙ্গে কথা বলেন। রোগীর বাড়িতে যাইয়া ছোট ছেলেদের সাজি হইতে মোয়া-মুড়ি চাহিয়া খান। ভিজিটের টাকার জন্য পীড়াপীড়ি করেন না।
এই ডাক্তারের সঙ্গে আমার একদিন পরিচয় হইল। তিনি আমার কাঁধে হাত দিয়া বলিলেন, “তোমাদের অঞ্চলের যত গরিব রোগীর খবর আমাকে দিবে। চিকিৎসার জন্য কোনো পারিশ্রমিক লাগিবে না। এমনকি ঔষধও আমি কিনিয়া দিব। তুমি আমাকে যেখানেই হুকুম করিবে সেখানেই যাইব।”
ইনি হইলেন ডাঃ সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। পরবর্তী জীবনে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিয়া জেল ও সুখ্যাতি সবকিছুরই ভাগী হইয়াছিলেন। ফরিদপুর জেলার নড়িয়া অঞ্চলে তাঁহার বাড়ি। বিবাহ করেন নাই। যা কিছু উপার্জন করেন তাহা কয়েকজন বন্ধুর পড়াশুনার খরচের জন্য কলিকাতা পাঠাইয়া দেন। এই বন্ধুরা উপযুক্ত হইয়া আসিলে তাঁহাদের লইয়া তিনি লোক-সেবার আশ্রম খুলিবেন।
আমার মায়ের মামাবাড়ি ছিল বাখুণ্ডা গ্রামে। সেখানে বেড়াইতে যাইয়া দেখি, তাঁহাদের বাড়ির একটি মেয়ে খুবই অসুস্থ। সম্পর্কে মেয়েটি আমার খালা। পেটটি ঢোলের মতো ফুলিয়া গিয়াছে। হাত-পা ফুলা ফুলা। আত্মীয়-স্বজনেরা তাঁহার বাঁচিবার আশা ছাড়িয়া দিয়াছেন। সুরেশদাকে যাইয়া এই মেয়েটির কথা বলিলাম। ফরিদপুর হইতে বাখুণ্ডা গ্রাম ছয়-সাত মাইল দূরে। সমস্ত শুনিয়া সুরেশদা বলিলেন, “মেয়েটিকে তুমি এখানে তোমাদের বাড়িতে লইয়া আস। আমি তাহার চিকিৎসা করিয়া দিব।”
আমি মেয়েটিকে আমাদের বাড়িতে লইয়া আসিলে সুরেশদা তাহাকে ভালোমতো পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, “মেয়েটির ক্রিমি হইয়াছে। কয়েক ডোজ ঔষধ দিলেই সারিয়া যাইবে।” ঔষধ লিখিয়া সুরেশদা হাসপাতালের লেডি-ডাক্তারকে একখানা পত্র লিখিয়া দিলেন। লেডি-ডাক্তারের বয়স সুরেশদার প্রায় সমান। তিনি পত্রে তাঁহাকে মা বলিয়া সম্বোধন করিলেন। হাসপাতাল হইতে ঔষধ আনিয়া দিলে কয়েকদিনের মধ্যেই রোগিণী ভালো হইয়া উঠিল। ইহার পর তাঁহার এমন সুন্দর চেহারা হইল যেন হিন্দুদের পূজার প্রতিমা। বিবাহের পরে তাঁহার দুই-তিনটি সন্তান হইয়াছিল। একবার কোনো সন্তানের জন্মের সময় মেয়েটি মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
ইহার পরে আরও অনেক গরিব রোগীর জন্য সুরেশদাকে নানা গ্রামে লইয়া গিয়াছি।
চলবে…..