সুবোধ ডাক্তার
ডাক্তারবাবুর নির্দেশমত প্রতিদিন সকালে আসিয়া হাইড্রোজেন প্যারাকসাইড দিয়া বৃদ্ধার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করিয়া বোরিক কটন দিয়া বাঁধিয়া দেই, হাতের ডানায় ইনজেকশন দেই। ছয়-সাতদিন পরে বৃদ্ধা ভালো হইয়া উঠিল। ইহার জন্য ঔষধপত্রের ব্যবস্থা ডাক্তারবাবুই করিয়াছিলেন।
এই বৃদ্ধা ভালো হইয়া উঠিয়া আরও দশ-বারো বৎসর বাঁচিয়াছিল। হাট হইতে তেঁতুল ও কুলের আচার কিনিয়া আনিয়া পাড়ার বউঝিদের কাছে সে বিক্রি করিয়া বেড়াইত। ইহাতে কিইবা তাহার আয় হইত। এই সামান্য আয়ে তাহার এটা-ওটা কিনিবার পয়সা জুটিত। সংসারে আপন বলিতে বোনপুত কেদারী। তারও অবস্থা ভালো না। গ্রামের বউরা বুড়িকে বড়ই মমতা করিত। এ-বাড়ি ও-বাড়ি খাইয়া তাহার দিন চলিত। আমার সেই সেবাকার্যের পুরস্কারস্বরূপ মাঝে মাঝে বুড়ি আমাকে কুলের আচার আনিয়া দিত। বহু সাধ্য-সাধনা করিয়াও বুড়িকে নিরস্ত করিতে পারিতাম না। বারবার অনুরোধ করিয়া সেই কুলের আচার সে আমাকে গছাইয়া দিত।
গ্রামের মোনা মল্লিকের খুব অসুখ। বিছানা হইতে উঠিতে পারে না। এই মোনা মল্লিকের সঙ্গে আমার ছেলেবেলার সম্পর্ক। সে নানারকম পাখি পালিত। ঘুঘু, কোড়া, ডাহুক প্রভৃতি শিকারী পাখিরা সব সময় তাহার বাড়িতে খাঁচায় আবদ্ধ থাকিত। বর্ষাকালে সে ডাহুক লইয়া জঙ্গলের মধ্যে তাহার খাঁচাটি রাখিয়া আড়ালে যাইয়া বসিয়া থাকিত। খাঁচার চারিধারে থাকিত ফাঁদ। পোষা ডাহুকের ডাক শুনিয়া বুনো ডাহুকেরা তাহার সঙ্গে ভাব করিতে আসিয়া সেই ফাঁদে আটকা পড়িত। দুই-একবার আমি তাহার সঙ্গে জঙ্গলে ডাক শিকারে গিয়াছিলাম।
ঘন বেতঝাড়ের আড়ালে যেখানে নিচু মাটিতে অল্প বৃষ্টির পানি জমিয়াছে, সেখানে অতি সাবধানে খাঁচাটি রাখিয়া সে আড়ালে যাইয়া বসিয়া থাকিত। আষাঢ় মাসে বনের শোভা বড়ই সুন্দর রূপ ধারণ করে। এখানে-সেখানে শ্যামা-লতা, তেলাকুচ লতা, আমগুরুজ লতা সবাই যুক্তি করিয়া সেই বেতবনের উপর নানারূপ সুনিপুণ কারুকার্য করিতে থাকে। এখানে-সেখানে দু’একটি হিজল গাছ রাশি রাশি রাঙা ফুল ছড়াইয়া সেই বনভূমিতে দেবকন্যাদের পায়ের অলক্তক রাগের চিহ্ন আঁকিয়া দেয়। এ-ডালে ও-ডালে কানাকুয়া ডাকে, ঘুঘু ডাকে। দূরের ধানক্ষেত হইতে কোড়ার ডাক কানে আসে। আমি দুই চোখ মেলিয়া বনের শোভা দেখিতাম-দুই কান মেলিয়া পাখির গান শুনিতাম। মোনা মল্লিক এতসব ভাবিত না। কখন তাহার খাঁচায় ডাহুক আসিয়া আটকা পড়িবে সে তাহাই ভাবিত।
মোনা মল্লিকের বাড়ি যাইয়া আমি তাহার খাঁচার পাখিগুলিকে দেখিতাম। একবার বাড়ির এটা-ওটা বেচিয়া কিঞ্চিৎ পয়সা সঞ্চয় করিয়া তাহার নিকট হইতে খাঁচাসমেত একটি ঘুঘুর বাচ্চা কিনিয়াছিলাম। আমার পিতা তাহা টের পাইয়া সেই পাখির বাচ্চা ফেরত দিয়াছিলেন। মোনা মল্লিকের সঙ্গে আমার একটি আত্মিক সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছিল। সে সুনিপুণ হাতে বাঁশ চিরিয়া সলা বানাইয়া মাছ ধরিবার দোয়াড়ি ও চাঁই তৈরি করিত। ধারালো দাখানি দিয়া সে বেত চাঁছিত। তাহার সুদক্ষ হাতের টানে বেতটি নাচিয়া নাচিয়া ধারালো দায়ের স্পর্শে মসৃণ হইয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িত। ধারালো অস্ত্রে কাঠ কাটার সময় যেমন, তেমনি তাহার বেত চাঁছিবার সময় আমি যেন আমার বুকের ভিতর কি এক রকম স্পন্দন অনুভব করিতাম।
তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিব না। এ-কাজে ও-কাজে তাহার বালিকা-বধূটি উঠানে ঘুরিয়া বেড়াইত। মাঝে মাঝে তাহাদের কৃত্রিম কলহ হইয়া আবার আপোশ হইত। তাহার বউটি গ্রামের মধ্যে নামকরা সুন্দরী ছিল। তখন কিইবা আমার বয়স। বোধ করি আট-নয় বৎসরের বেশি হইবে না। কিন্তু তখনও হয়তো মনের অগোচরে আমার ভিতর সৌন্দর্যের প্রতি অবচেতন আকর্ষণ ধীরে ধীরে রূপ পাইতেছিল।
এই মোনা মল্লিকের অসুখের খবর শুনিয়া আমি সুবোধবাবু ডাক্তারকে ডাকিয়া আনিলাম। ডাক্তার রোগীর অবস্থা ভালোমতো পরীক্ষা করিয়া ঔষধ-পথ্যের নির্দেশ দিলেন। সব ঔষধ কিনিতে প্রায় বিশ টাকার মতো লাগিবে। এত টাকা মোনা মল্লিক কোথা হইতে দিবে? ডাক্তারবাবু তাঁহার বন্ধু জমিদার ইন্দ্রভূষণ সরকার মহাশয়কে পত্র লিখিয়া দিলেন। সেই পত্র পাইয়া তিনি ঔষধ-পত্রের খরচের জন্য আমার হাতে বিশটি টাকা দিলেন।
চলবে…..