সুবোধ ডাক্তার
আমি রোজ যাইয়া মোনা মল্লিককে দেখাশুনা করিতে লাগিলাম। ডাক্তারের নির্দেশমতো প্রতিদিন তাহাকে ডুস দিয়া পায়খানা করাইতে হইত। গরম পানি দিয়া সমস্ত গা মুছাইয়া দিতে হইত। তাহা ছাড়া গরম পানিতে ঔষধ মিশাইয়া তাহার ময়লা দাঁতগুলি প্রতিদিন পরিষ্কার করিয়া দিতাম। এইসব কাজে তাহার স্ত্রী এটা-ওটা আনিয়া আমাকে সাহায্য করিত। তাহাকে আমি গ্রাম সম্পর্কে চাচি বলিতাম। আমার চাইতে দশ-বারো বৎসরের বড়। বয়স এখনই ভাঙিয়া পড়িতেছে। ডাক্তার রোগীকে কেবলমাত্র দুধ খাইতে বলিয়াছিলেন। সেই দুধের টাকাও আমি এর-ওর নিকট হইতে চাহিয়া-চিন্তিয়া আনিয়া দিতাম। প্রতিদিন সকালে-বিকালে প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা ধরিয়া রোগীকে দেখাশুনা করিতে লাগিলাম। রোগীর অবস্থাও ডাক্তারবাবুকে শহরে যাইয়া বলিতাম।
একদিন মোনা মল্লিকের বাড়ি হইতে বাহির হইয়া যাইতেছি এমন সময় রহিম মল্লিকের মা আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “ভাই জসীম। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।” রহিম মল্লিকের মাকে আমি গ্রামসম্পর্কে দাদি বলিয়া ডাকিতাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি কথা দাদি। পথের মধ্যে তোমার সঙ্গে প্রেমালাপ করিব, লোকে বলিবে কি?” দাদি-সম্পর্কের বৃদ্ধাদিগের সঙ্গে এরূপ রহস্যালাপ করিয়া গ্রামদেশের লোকেরা নিজেদের জীবনে সাময়িক আনন্দ আনিয়া থাকে। দাদি বলিল, “তামাশার কথা নয় ভাই? আমি তো শুনিয়া আসমান হইতে পড়িয়া গেলাম। ওই হদার মা বুড়ি, তাকে আমি ঝাঁটা দিয়া পিটাইয়া কুটি কুটি করি, সে কিনা বলে, জসী যে মোনা মল্লিকের অসুখে এত দেখাশুনা করিতেছে, ইহার কারণ মোনা মল্লিকের বউ-এর সঙ্গে তাহার দোষ আছে।”
তখন আমার বয়স বড়জোর চৌদ্দ বৎসর। নবম শ্রেণীতে পড়ি। ইত্যাকার অপবাদ যে কেহ কারও প্রতি করিতে পারে তাহা আমার বুদ্ধির অগোচর। আমার পায়ের তলা হইতে যেন মাটি সরিয়া গেল। সেই হদার মা বুড়ি একথা তো শুধু দাদিকেই বলে নাই। হয়তো পাড়ার আরও অনেককে বলিয়াছে। দাদি আমার মনের অবস্থা বুঝিতে পারিয়া আমাকে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, “আমি কিন্তু ভাই তোমাকে চিনি। এর এক বর্ণও বিশ্বাস করি নাই। বলুক না যাকে যত খুশি। মিথ্যা কথা বলায় তাদের মুখ খসিয়া পড়িবে। তোমার তাহাতে কিছুই হইবে না।” দাদি সান্ত্বনা দিতে আমার মনের অবস্থাকে আরও বাড়াইয়া দিল। বাড়ি ফিরিতে ফিরিতে দাদির শেষ কথাটি বারবার ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হইয়া আমার অন্তরকে করাত দিয়া কাটিতে লাগিল: “বলুক না যাকে যত খুশি।” তবে কি সকলের কাছেই বড়ি এই কথা বলিয়া বেড়াইতেছে।
এরপর তিন-চারিদিন আর মোনা মল্লিকের বাড়ি গেলাম না। সেদিন স্টেশনের রাস্তা পার হইয়া শহরে যাইতেছি, এমন সময় সুবোধবাবুর সঙ্গে দেখা। তিনি সাইকেলে করিয়া দূরের কোনো কলে যাইতেছিলেন। আমাকে দেখিয়া সাইকেল হইতে নামিলেন। “কই, মোনা মল্লিকের অবস্থা জানাইতে তুমি তো আর আসিলে না। রোগী কেমন আছে?”
আমি তখন ডাক্তারবাবুকে সমস্ত খুলিয়া বলিলাম। শুনিয়া ডাক্তার বাবু উচ্চ হাসিয়া বলিলেন, “আরে জসীম। তুমি এটা জান নাই? তোমার মতো একটি ছেলে নিঃস্বার্থভাবে যে কোনো গরিব লোককে সাহায্য করিতে পারে এটা গ্রামদেশের লোকদের কল্পনারও অগোচর। আমরা ভদ্রলোকেরা চিরকাল শুধু তাহাদের এক্সপ্লয়েটই করিয়াছি। তাই এই বৃদ্ধা মহিলা তোমার কাজ দেখিয়া তার নিজের বুদ্ধির মতো এটা-ওটা নানারকম জল্পনা-কল্পনা করিয়াছে। পরিশেষে ভাবিতে ভাবিতে এই আবিষ্কার করিয়াছে যে, মোনা মল্লিকের বউ-এর সঙ্গে তোমার দোষ আছে। এ কি যেমন-তেমন আবিষ্কার। এজন্য এই বৃদ্ধাকে কত মাথা খাটাইতে হইয়াছে। তোমার কাজের কথা লইয়া সে যে এত ভাবিয়াছে, এই তো তোমার পুরস্কার। এজন্য মন খারাপ করিও না।”
চলবে…..