সুবোধ ডাক্তার
ডাক্তারবাবুর কথাগুলি এমনই স্নেহপূর্ণ আর হৃদ্যতা-মাখানো যে পরদিন হইতে আমি আবার যাইয়া মোনা মল্লিককে দেখাশুনা করিতে লাগিলাম। অসুখ হইতে সারিয়া উঠিয়া মোনা মল্লিক আরও কয়েক বৎসর বাঁচিয়াছিল। তাহার ছেলে এখনও আমার প্রতি বড়ই কৃতজ্ঞ। দেশে গেলে এটা-ওটা কাজ করিয়া দিতে তাহার পিতাকে যে একদিন আমি সেবা করিয়াছিলাম এই কথার উল্লেখ করে।
কালক্রমে সুবোধ ডাক্তারের বিরুদ্ধে শহরের অন্যান্য ডাক্তারেরা উঠিয়া-পড়িয়া লাগিলেন। তিনি প্রত্যেক রোগীকে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরিয়া দেখিতেন। অন্যান্য ডাক্তারেরা বলিত, “সুবোধবাবুর বুদ্ধি কম। তাই রোগীর রোগ নির্ণয় করিতে অনেক সময় লাগায়।” ইহা ছাড়া তিনি প্রায়ই গ্রামদেশের কলে যাইয়া চার-পাঁচদিন কাটাইতেন। শহরের রোগীরা প্রতিদিন ডাক্তারের উপস্থিতি কামনা করি। বিশেষ করিয়া রোগী যদি ঘোরতর হয় ডাক্তারকে দুই বেলা কল দিয়া উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রোগীকে দেখায়। দিনে দিনে তাই শহরে ডাক্তারবাবুর কল কমিয়া আসিল। গ্রামদেশের ধনীলোকেরা শহরের অনুকরণ করে। গ্রামে বসিয়াও তাহারা নিজেদের আওতায় এক-একটি মানসিক শহুরিয়া পরিবেশ গড়িয়া লয়। শহরে যে-ডাক্তারের কল নাই সেই ডাক্তারকে তাহারা পারতপক্ষে ডাকে না। এইভাবে ধীরে ধীরে সুবোধবাবুর উপার্জন কমিয়া যাইতে লাগিল।
এই সময়ে তিনি লাঠিখেলা ও তলোয়ার চালনায় মনোনিবেশ করিলেন। কতদিন তাঁহার বাড়িতে যাইয়া দেখিয়াছি, বৈঠকখানার ঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোগীরা অপেক্ষা করিতেছে। তিনি অন্দরমহলে কোনো বন্ধুকে তাঁহার তলোয়ার ভাঁজের নূতন কলাকৌশল দেখাইতেছেন। গ্রামদেশে রোগী দেখিতে যাইয়াও তিনি কোথাও লাঠিখেলার কোনো ওস্তাদ পাইলে সমস্ত ভুলিয়া তাহার নিকট হইতে শিক্ষা গ্রহণ করিতে লাগিয়া যাইতেন। মাঝে মাঝে তিনি বাঘের ছাল পরিয়া গ্রামদেশের লোকদিগকে লাঠিখেলা দেখাইয়া স্তম্ভিত করিতেন। তাঁহার ছয় বৎসরের ছেলেটির মাথায় একটি আলু রাখিয়া তিনি চোখ বন্ধ করিয়া তলোয়ার দিয়া সেই আলু দুইখণ্ড করিতেন। ছেলেটিকে আবার মাটিতে শোয়াইয়া তাহার গলার উপর একটি লাউ রাখিয়া সেই লাউ চোখ বন্ধ অবস্থায় কাটিতেন। গ্রামদেশে যেখানে যত লাঠিয়াল ছিল তাহাদিগকে তিনি দলবদ্ধ করিতে চেষ্টা করিতেন।
তাঁহার ধারণা ছিল, সেই দলবদ্ধ লাঠিয়ালদের লইয়া তিনি একদিন দুর্ধর্ষ ইংরেজ গভর্নমেন্টের সহিত সংগ্রাম করিবেন। মাঝে মাঝে এ-গ্রাম সে-গ্রাম হইতে লাঠিয়ালেরা দশ-বারোজন আসিয়া দুই-তিনদিন ডাক্তারবাবুর বাসায় থাকিয়া শিক্ষাগ্রহণ করিত। বলা বাহুল্য যে, ডাক্তারবাবু তাহাদের জন্য দুইবেলা বেশ ভালো আহারের ব্যবস্থা করিতেন। গভর্নমেন্টের লোকেরাও বোধহয় তাঁহার লাঠিয়াল সংগঠনের কথা জানিতেন। কিন্তু আধুনিক কামান গোলা প্রভৃতি মারণাস্ত্রের অধিকারী ব্রিটিশ-সিংহের বিরুদ্ধে এই পাগলা ডাক্তারের কয়েকশত লাঠিয়াল লইয়া আস্ফালন যে কোনোই কাজে আসিবে না তাহা হয়তো তাঁহারা জানিতেন বলিয়াই ডাক্তারবাবুর কাজে তাঁহারা হস্তক্ষেপ করিতেন না।
গভর্নমেন্টের লোক ডাক্তারবাবুর কাজে হস্তক্ষেপ করিতেন না কিন্তু তাঁর দেশবাসী তাঁহাকে কপর্দকশূন্য করিয়া ছাড়িল। একে তো শহরের ধনী ব্যক্তিদের বাড়িতে তাঁহার কল কমিয়া গেল, গ্রামদেশের ধনী ব্যক্তিরাও তাঁহাকে কম ডাকিতে লাগিলেন। যখন শহরের কোনো ডাক্তার দূরের পথে কোথাও যাইতে চাহিতেন না তখন সুবোধ ডাক্তারের ডাক পড়িত। ইহাতেও তাঁহার মাসিক আয় তিন-চারশত টাকার মতো হইত। কিন্তু হইলে কি হইবে? ডাক্তারবাবুর দানের হাত তো কমিল না। গরিব রোগীকে দেখিয়াও তিনি বেশি দামের ঔষধ ব্যবস্থা করিতেন। তিনি বলিতেন, “রোগী গরিব হইতে পারে কিন্তু তার রোগটা তো গরিব নয়।” এই কথা প্রমাণ করিতে তাঁকে গরিব রোগীদের সমস্ত ঔষধের দাম দিতে হইত।
শহরের দুই-তিনটি ঔষধের দোকানে ডাক্তারবাবুর নামে দুই-তিন হাজার টাকা দেনা হইল। তাহারা দেনার দায়ে নালিশ করিল। তবু তাঁহার দানের হাত কমিল না। নিজের ছেলেটির জন্য প্রাইভেট মাস্টার রাখিয়া দিয়াছিলেন। অর্থাভাবে তাঁহাকে ছাড়াইয়া দিলেন। ছেলেটি এ-পাড়ায় ও-পাড়ায় ঘুরিয়া জটলা করিয়া বেড়াইত, পড়াশুনা করিত না। এদিকে মন দেওয়ার অবসর তাঁহার কোথায়? বৌদিদির অলঙ্কারগুলি ধীরে ধীরে সেকরার দোকানে যাইয়া জমা হইতে লাগিল। কতদিন এই দেবীতুল্যা বৌদিদিকে তালি দেওয়া শাড়ি পরিতে দেখিয়াছি। ডাক্তারবাবুর সেদিকে খেয়াল ছিল না। রোগী পাইলে তিনি সকল ভুলিয়া যাইতেন। বিশেষ করিয়া গরিব মুসলমান চাষীর বাড়ি হইতেই তাঁহার বেশি কল আসিত।
চলবে…..
Leave a Reply