সুবোধ ডাক্তার
কতদিন ডাক্তারবাবুর সঙ্গে তাঁহার রোগীর বাড়ি গিয়াছি। একবার আমাদের গ্রামের একটি চাষীর বাড়িতে যাইয়া দেখিলাম ভিজা স্যাঁতসেঁতে মেঝের উপর একটি ছেঁড়া মাদুরের উপর রোগী শুইয়া আছে। ডাক্তারবাবু প্রথমেই বাড়ির কর্তাকে আদেশ করিলেন খড়ের পালা হইতে একবোঝা খড় আনিয়া দাও। সেই খড় পরিপাটি করিয়া ঘরের মেঝেয় বিছাইয়া তাহার উপর কাঁথা মেলিয়া প্রথমে রোগীকে সেখানে শোয়াইয়া দিলেন। রোগী আরামের নিশ্বাস ফেলিল। তার পাশে আর একটি খড়ের বিছানা পাতিয়া সেখানে বসিয়া তিনি রোগী দেখিতে লাগিলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক রোগী দেখিয়া ডাক্তার বলিলেন, “রোগীর নিউমোনিয়া হইয়াছে, ইহাকে সব সময় গরম রাখিতে হইবে। ঠাণ্ডা লাগিলে রোগী বাঁচিবে না। গ্রামে কোথাও পুরাতন ঘি আর আকনের পাতা আছে কি না লইয়া আস।”
আকনের পাতায় পুরাতন ঘি মাখাইয়া তাহা আগুনের উপর সেকিয়া ডাক্তারবাবু নিজেই রোগীর বুকে সেঁক দিতে লাগিলেন। আর বাড়ির বধূটিকে কি করিয়া সেঁক দিতে হইবে শিখাইতে লাগিলেন।
এমনি করিয়া তিনি প্রত্যেক রোগীর বাড়ি যাইয়া কোনো দরদি বন্ধুর মতো তাহাদের দেখাশুনা করিতেন। এইসব লোকেরা শতকণ্ঠে ডাক্তারবাবুর তারিফ করিত। কিন্তু তাহারা তো দেশের গণ্যমান্য কেহ নয়। তাহাদের মতামতের দাম পোড়া দেশে কে দিবে?
নানা রকম পাওনাদারের অত্যাচারে আর স্বগোত্রীয় ডাক্তারদের সমালোচনায় ধীরে ধীরে ডাক্তারবাবুর মধ্যে উন্মাদ রোগের লক্ষণ দেখা দিল। আত্মীয়স্বজনেরা তাঁহাকে কলিকাতা লইয়া গেলেন চিকিৎসা করাইতে। শুনিতে পাইলাম, সেখানে যাইয়া উম্মাদ অবস্থায় একদিন তিনি বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করিয়াছেন। দরিদ্র দুস্থ মুসলমান-হিন্দু চাষীদের এত বড় দরদি-বন্ধুর এমন মহৎ-জীবন এইভাবে শেষ হইয়া যাইবে তাহা কোনোদিনই ভাবিতে পারি নাই। আর সেই জনদরদি মানুষ-দেবতাকে কোনোদিনই দেখিতে পাইব না। দেবতা কোনোদিনই দেখি নাই। প্রতিমা বানাইয়া যাহারা দেবতার পূজা করে তাহাদের সঙ্গেও একমত হইতে পারি নাই। কিন্তু আজ মন বলিতেছে, এককালে হয়তো ডাক্তারবাবুর মতো মানুষই আপন জীবনের মহিমায় তাঁর পারিপার্শ্বিক সবাইকে এমনি করিয়া মুগ্ধ করিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহারা চলিয়া গেলে গুণগ্রাহীরা তাঁহাদের প্রতিমা গড়াইয়া মন্দিরে মন্দিরে পূজা আরম্ভকরিয়াছিল। সেকালের আদর্শবাদ হয়তো একালের আদর্শ নয়। হয়তো তাঁহাদের জীবনের যা সত্যকার মহিমা ছিল তাহাও আজ নানা উদ্ভট কল্পনায় ঢাকা পড়িয়াছে। কিন্তু তাঁহাদের পূজা আজও চলিতেছে। আমি প্রতিমায় বিশ্বাস করি না। তবু কেহ যদি আজ ডাক্তারবাবুর প্রতিমা গড়িয়া কোথাও পূজা করে, আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পূজাঞ্জলি সেইখানে আমি নিবেদন করিব।
ডাক্তারবাবুর মৃত্যুর পরে একদিন আমি অম্বিকাপুরের স্টেশনের রাস্তা দিয়া বাড়ি ফিরিতেছি। দেখিলাম, ডাক্তারবাবুর স্ত্রী তাঁর ছেলে আর মেয়েটিকে সঙ্গে লইয়া ফরিদপুর হইতে দেশের বাড়ি গোপালপুরে চলিয়া যাইতেছেন। এত বড় লোকের স্ত্রী, আজ একখানা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করিবারও তাঁহার সামর্থ্য নাই। বউদিদির মাথায় সেই উজ্জ্বল সিন্দুরবিন্দুটি আজ আর শোভা পাইতেছে না।
কি দুঃসহ অর্থকষ্ট লইয়াই যে বউদিদি আজ শহরের বাড়ি হইতে সেই সুদূর পল্লীগ্রামে চলিয়া যাইতেছেন তাহা বুঝিতে কষ্ট হইল না। সেখানে যাইয়া ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা হইবে না। শহরের জীবনে যাঁহারা অভ্যস্ত, শত কুসংস্কার ও অজ্ঞানতাপূর্ণ পাড়াগাঁয়ে যাইয়া তাঁহারা কিরূপে বাস করিবেন। অনেক কষ্টে চোখের পানি রোধ করিলাম। আহা! ওরা তো কতই কাঁদিয়াছে! আমি কাঁদিয়া আবার উহাদের কাঁদাইব কোন প্রাণে!
আমার জীবনে কত মানুষের সংস্পর্শেই আসিয়াছি, এই ডাক্তারবাবুর মতো লোক একজনও দেখিলাম না। ফরিদপুরের মিউনিসিপ্যালিটিতে শুনিয়াছি আজ কয়েকজন তরুণ যুবক নেতৃস্থান দখল করিয়াছেন। তাঁহারা কি শহরের কোনো রাস্তা সুবোধবাবুর নামে নামকরণ করিয়া এই মহানুভব ব্যক্তিটির প্রতি সামান্য কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করিতে পারেন না?
আজ আমার বিগত জীবনের দিকে যতদূর চাহিয়া দেখি, আমার পিতা, সুরেশবাবু, সুবোধ ডাক্তার এমনি কত মহৎ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম। তাঁহারা কি আমার জীবনে এতটুকুও আদর্শ রাখিয়া গিয়াছেন? সেই আত্মত্যাগ-সেই পরার্থে সকল সমর্পণ-জীবনের দেউলিয়া দিনগুলির সঙ্গে তাঁহাদের মহৎ-সংসর্গের দিনগুলি তুলনা করিয়া কেবলই মনে হয়, সেখানে শুধুই শূন্যতা-শুধুই শূন্যতা জমা হইয়া আছে। তাই এত করিয়া তাঁহাদের কথা লিখিয়া গেলাম; দেশের অনাগত কালের ভাইবোনেরা যদি এসব জানিয়া কোনো আদর্শবাদের সন্ধান পায়!
চলবে…..
Leave a Reply