বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ০৩:৩৯ পূর্বাহ্ন

স্বয়ম্বরা

  • Update Time : শুক্রবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৫, ৭.০০ পিএম

রাজশেখর বসু

চাটুজ্যেমশায় পাঁজি দেখিয়া বলিলেন-‘রাত্রি ন-টা সাতান্ন মিনিট গতে অম্বরাচা নিবৃত্তি। তার আগে এই বৃষ্টি থামবে না। এখন তো সবে সন্ধ্যে।’

বিনোদ উকিল বলিলেন-‘তাই তো, বাসায় ফেরা যায় কি ক’রে।’

গৃহস্বামী বংশলোচনবাবু বলিলেন-‘বৃষ্টি থামলে সে চিন্তা ক’রো। আপাতত এখানেই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হোক। উদো, ব’লে আয় তো বাড়ির ভেতর।’

চাটুজ্যে বলিলেন-‘মসুর ডালের খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা।’

বিনোদবাবু তাকিয়াটা টানিয়া লইয়া বলিলেন-‘তা তো হ’ল, কিন্তু ততক্ষণ সময় কাটে কিসে। চাটুজ্যেমশায়, একটা গল্প বলুন।’

চাটুজ্যে ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন-‘আর-বছর মুঙ্গেরে থাকতে আমি এক বাঘিনীর পাল্লায় পড়েছিলুম।’

বিনোদবাবু বাধা দিয়া বলিলেন-‘দোহাই চাটুজ্যেমশায়, বাঘের গল্প আর নয়।’

চাটুজ্যে একটু ঘুম হইয়া বলিলেন-‘তবে কিসের কথা বলব, ভূতের না সাপের?’ -‘এই বর্ষায় বাঘ ভূত সাপ সমস্ত অচল, একটি মোলায়েম দেখে প্রেমের গল্প বলুন।’

-‘গল্প আমি বলি না। যা বলি, সমস্ত নিছক সত্য কথা।’

-‘বেশ তো একটি নিছক সত্য প্রেমের কথাই বলুন।’

নগেন বলিল-‘তবেই হয়েছে চাটুজ্যেমশায় প্রেমের কথা বলবেন! বয়স কত হ’ল চাটুজ্যেমশায়? আর কটা দাঁত বাকী আছে?’

-‘প্রেম কি চিবিয়ে খাবার জিনিস? ওরে গর্দভ, দাঁতে প্রেম হয় না, প্রেম হয় মনে।’

নগেন বলিল-‘মন তো শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। প্রেমের আপনি জানেন কি? সব ভুলে মেরে দিয়েছেন। প্রেমের কথা বলবে তরুণরা। কি বলিস উদো?’

তরুণ কি রে বাপু? সোজা বাংলায় বল্ চ্যাংড়া। তিন কুড়ি বয়েস হ’ল, কেদার চাটুজো প্রেমের কথা জানে না, জানে যত হ্যাংলা চ্যাংড়ার দল।’

বিনোদবাবু, বলিলেন-‘আঃ হা, কেন ব্রাহ্মণকেও চটাও, শোনই না ব্যাপারটা।’

চাটুজ্যে বলিলেন-‘বর্ণের শ্রেষ্ঠ হলেন ব্রাহ্মণ। দর্শন বল, কাব্য বল, প্রেমতত্ত্ব বল, সমস্ত বেরিয়েছে ব্রাহ্মণের মাথা থেকে। আবার ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ হলেন চাটুজ্যে। যথা বঙ্কিম চাটুজ্যে, শরৎ চাটুজ্যে-‘

‘আর?’

-‘আর এই ক্যাদার চাটুজ্যে। কেন বলব না? তোমাদের ভয় করব নাকি?’

-‘যাক যাক, আপনি আরম্ভ করুন।’

চাটুজোমশায় আরম্ভ করিলেন-‘আর বছরের ঘটনা। আমি এক অপরূপ সুন্দরী নারীর পাল্লায় পড়েছিলুম।’

নগেন বলিল-‘এই যে বলছিলেন বাঘিনীর পাল্লায়?’

বিনোদ বলিলেন-‘একই কথা।’

চাট,জ্যে বলিলেন-‘ওরে মুখখ বাঘিনীর পাল্লায় পড়েছিলুম মুঙ্গেরে, আর এই নারীর ব্যাপার ঘটেছিল পঞ্জাব মেলে, টুন্ডলার এদিকে। যাক, ঘটনাটা শোন।-

গেল বছর মাঘ মাসে চরণ ঘোষ বললে তার ছোট মেয়েটিকে টুন্ডলায় রেখে আসতে, জামাই সেখানেই কর্ম করে কিনা। সুবিধেই হ’ল, পরের পয়সায় সেকেন্ড ক্লাসে ভ্রমণ, আবার ফেরবার পথে একদিন কাশীবাসও হবে। মেয়েটাকে তো নির্বি-বাদে পৌঁছিয়ে দিলুম। ফেরবার সময় টুন্ডলা স্টেশনে দেখি গাড়িতে তিলার্ধ জায়গা নেই, আগ্রার ফেরত এক পাল মার্কিন ভবঘুরে সমস্ত ফার্স্ট সেকেন্ড ক্লাসের বেঞ্চি দখল ক’রে আছে। ভাগ্যিস জামাই রেলের ডাক্তার, তাই গার্ডকে ব’লে ক’য়ে আমায় একটা ফার্স্ট ক্লাসে ঠেলে তুলে দিলে। গাড়িও তখনই ছাড়ল।

তখন সকাল সাতটা হবে, কিন্তু কুয়াশায় চারিদিক আচ্ছন্ন, গাড়ির মধ্যে সমস্ত রাপসা। কিছুক্ষণ ধাঁধা লেগে চুপটি ক’রে দাঁড়িয়ে রইলুম, তারপর রুমে ক্রমে কামরার ভেতরটা ফুটে উঠল।

দেখেই চক্ষু স্থির। ওধারের বেঞ্চিতে একটা অসুরের মতন আখাম্বা ঢ্যাঙা সায়েব চিতপাত হ’য়ে চোখ বুজে হাঁ করে শুয়ে আছে, আর মাঝে মাঝে বিড়বিড় ক’রে কি বলছে। দু-বেঞ্চির মাঝে মেঝের ওপর আর একটা বেটে মোটা সায়েব মুখ গাজে ঘুমুচ্ছে, তার মাথার কাছে একটা খালি বোতল গড়াগড়ি যাচ্ছে। এধারের বেঞ্চিতে কেউ নেই, কিন্তু তাতে দামী বিছানা পাতা, তার ওপর একটা অদ্ভুত পোশাক -বোধ হয় ভাল্লুকের চামড়ার, আর নানা রকম জিনিসপত্র ছড়ানো রয়েছে। গাড়ি চলছে, পালাবার উপায় নেই। বেঞ্চির শেষদিকে একটা চেয়ারের মতন জায়গা ছিল, তাইতে ব’সে দুর্গানাম জপতে লাগলুম। কোনও গতিকে সময় কাটতে লাগল, সায়ের দুটো শুয়েই রইল, আমারও একট, একটু, ক’রে মনে সাহস এল।

হঠাৎ বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক অপরূপ মূর্তি। দূর থেকে বিস্তর মেমসায়েব দেখেছি, কিন্তু এমন সামনাসামনি দেখবার সুযোগ কখনও ঘটে নি। মুখখানি চীনে করমচা, ঠোঁট দুটি পাকা লঙ্কা, মারবেলে কোঁদা আজানুলম্বিত

দুই বাহু। চোস্ত ঘাড়-ছাঁটা, কেবল কানের কাছে শণের মতন দুগাছি চুল কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। পরনে একটি দেড়হাতী গামছা-‘

বিনোদবাবু বলিলেন-‘গামছা নয় চাটুজোমশায়, ওকে বলে স্কার্ট।’

-‘কাঠ-ফাট জানি নে বাবা। পষ্ট দেখলুম বাঁদিপোতার গামছা খাটো ক’রে পরা তার নীচে নেমে এসেছে গোলাপী কলাগাছের মতন দুই পা. মোজা আছে কি নেই বুঝতে পারলুম না। দেহষষ্টি কথাটা এতদিন ছাপার হরফেই পড়েছি, এখন সবচঙ্কে দেখলুম-হাঁ, যষ্টি বটে, মাথা থেকে বুক-কোমর অবধি একদম চাঁচাছোলা, কোথাও একটু উচুনীচ, টক্কর নেই। সভ্যারিণী পল্লবিনী লতেব নয়, একবার জলন্ত হাউই-এর কাঠি। দেখে বড়ই ভক্তি হ’ল। কপালে হাত ঠেকিয়ে বললুম-সেলাম মেমসাহেব।

ফিক ক’রে হাসলেন। পাকা লঙ্কার ফাঁক দিয়ে গ.টিকতক কাঁচা ভুট্টার দানা দেখা গেল। ঘাড় নেড়ে বললেন-ঘুৎ মর্নিং।

দূর থেকে বিস্তর মেমসাহের দেখেছি

মেম নৃত্যপরা অপ্সরার মতন চঞ্চল ভঙ্গীতে এসে বেঞ্চে বসলেন। আমি কাঁচু-মাচু হ’য়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লুম। মেম বললেন-সিট ডাউন বাবু, ডরো মৎ।

দেবীর এক হাতে বরাভয়, অপর হাতে সিগারেট। বুঝলুম প্রসন্ন হয়েছেন, আর আমায় মারে কে। ইংরিজী ভাল জানি না, হিন্দী ইংরিজী মিশিয়ে নিবেদন করলুম -নিতান্ত স্থান না পেয়েই এই অনধিকারপ্রবেশ করেছি, অবশ্য গার্ডের হুকুম নিয়ে;

মেমসাহেব যেন কসুর মাফ করেন। মেম আবার অভয় দিলেন, আমিও ফের ব’সে পড়লুম।

কিন্তু নিস্তার নেই। মেমসায়েব আমার পাশে ব’সে একটু দাঁত বার ক’রে আমাকে একদস্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।

এই কেদার চাটুজোকে সাপে তাড়া করেছে, বাঘে পেছ নিয়েছে, ভূতে ভয় দেখিয়েছে হনুমানে দাঁত খিচিয়েছে, পুলিসকোর্টের উকিল জেরা করেছে, কিন্তু

কিন্তু এমন সামনাসামনি-

এমন দূরবস্থা কখনও ঘটে নি। ষাট বছর বয়েস, না, পাঁচ দিন ক্ষৌরি হয় নি, মুখ যেন কদম ফুল, ক’রে লজ্জা এসে আমার আকর্ণ বেগনী ক’রে দিলে। মেমসাব, কেয়া দেখতা? রংটি উজ্জল শ্যাম বলা চলে কিন্তু এই সমস্ত বাধা ভেদ থাকতে না পেরে বললুম-

মেম হ-হ, ক’রে হেসে বললেন-কুছ নেছি, নো অফেন্স। তুম কোন্ হ্যায় বাবু?

আমার আত্মমর্যাদায় ঘা পড়ল। আমি কি সঙ না চিড়িয়াখানার জন্তু? বুক চিতিয়ে মাথা খাড়া ক’রে বললুম-আই কেদার চাটুজ্যে, নো জু-গার্ডেন।

সেম আবার হ-হা করে হেসে বললেন-বেলালী?

আমি সগর্বে উত্তর দিলাম ইয়েস সার, হাই কাস্ট বেঙ্গালী ব্রাহ্মিণ। পইতেটা টেনে বার ক’রে বললুম-সী? আপ কোন্ হ্যায় ম্যাডাম?’

বিনোদবাব, বলিলেন-‘ছি চাটুজোমশায়, মেয়ের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। ওটা যে এটিকেটে বারণ।’

‘কেন করব না? মেম যখন আমার পরিচয় নিলে তখন আমিই বা ছাড়ব কেন?

মেম মোটেই রাগ করলেন না, জানালেন তাঁর নাম জোন জিলটার, নিবাস আমেরিকা এদেশে এর পূর্বেও ক-বার এসেছিলেন, ইন্ডিয়া বড় আশ্চর্য জায়গা।

আমি সাহস পেয়ে সায়েব দুটোকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম-এ’রা কারা?

মেমটি বড়ই সরলা। বেন্ডির উপরের ঢ্যাঙা সায়েবের দিকে কড়ে আঙুল বাড়িয়ে বললেন-দ্যাট চ্যাপি হচ্ছেন টিমথি টোপার, নিবাস কালিফোর্নিয়া, আমাকে বিবাহ করতে চান। ইনি দশ কোটির মালিক। আর যিনি গড়াগড়ি যাচ্ছেন, উনি হচ্ছেন ক্রিস্টফার কলম্বাস রটো, ইনিও আমাকে বিবাহ করতে চান, এ’রও দশ কোটি ডলার আছে।

আমি গম্ভীরভাবে বললুম-কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন।

মেম বললেন-সে অন্য লোক। এরা আমেরিকায় থেকেও কিছু আবিষ্কার করতে পারেন নি। দেশটা একদম শুকিয়ে গেছে, মেথিলেটেড স্পিরিট ছাড়া কিছুই মেলে না। তাই এ’রা দেশত্যাগী হ’য়ে খাঁটি জিনিসের সন্ধানে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

জিজ্ঞাসা করলুম-এরা বুঝি মস্ত স্পিরিচুয়ালিস্ট?

মেম বললেন-ভেরি!

এমন সময় ঢ্যাঙা সায়েবটা চোখ মেলে কটমট ক’রে চেয়ে আমার দিকে ঘুষি তুলে বললে-ইউ-ইউ গেট আউট কুইক। বেটেটাও হঠাৎ হাত-পা ছড়তে শর করলে।

আমি আমার লাঠিটা বাগিয়ে ধ’রে ঠক ঠক ক’রে ঠুকতে লাগলুম। মেমসায়েব বিছানা থেকে তাঁর পালকমোড়া চটিজুতো তুলে নিয়ে ঢ্যাঙার দুই গালে পিটিয়ে আদর ক’রে বললেন-ইউ পর্, ইউ পগ। বে’টেটাকে লাথি মেরে বললেন-ইউ পিগ, ইউ পিঙ্গু। দুটোই তখনই আবার হাঁ ক’রে ঘুমিয়ে পড়ল। মেম তাদো বুকের ওপর এক-এক পাটি চটি রেখে দিয়ে স্বস্থানে ফিরে এসে বললেন-ভয় নেই বাবু।

ভরসাই বা কই? আরব্য উপন্যাসে পড়েছিলুম একটা দৈত্য এক রাজকন্যাকে সিন্দুকে পুরে মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াত। দৈত্যটা ঘুমুলে রাজকন্যা তার বুকের ওপর একটা ঢিল রেখে দিয়ে যত রাজ্যের রাজপুত্তর জুটিয়ে আংটি আদায় করতেন। ভাবঈম এইবার সেরেছে রে! এই মেমসায়েব দু-দুটো দৈত্যের ঘাড়ে চ’ড়ে বেড়াচ্ছে, এখনই নিরানব্বই আংটির মালা বার করবে।

যা ভয় করছিলুম ঠিক তাই। আমার হাতে একটা রূপো আর তামার তারে জড়ানো পলা-বসানো আংটি ছিল। মেম হঠাৎ সেটাকে দেখে বললেন-হাউ ললি। দেখি বাবু কি রকম আংটি।

আমি ভয়ে ভয়ে হাতটি এগিয়ে দিলুম, যেন আঙুলহাড়া অন্তর করাচ্ছি। মেম ফস্ করে আংটিটি খুলে নিয়ে নিজের আঙুলে পরিয়ে বললেন-বিউচিফঃ!

হবে রাম! এ যে আমার ত্রিসন্ধ্যা জপ করার আংটি, হায় হায়, এই স্লেচ্ছ মাগী সেটাকে অপবিত্র ক’রে দিলে! আমার চোখ ছলছল ক’রে উঠল, কিন্তু কৌতূহলও খুব হ’ল। বললুম-মেমসায়েব, আপকা আর কয়ঠো আংটি হ্যায়? নাইন্টিনাইন?

মেম বেন্টির তলা থেকে একটি তোরঙ্গ টেনে এনে তা থেকে একটি অদ্ভুত বাক্স খুলে আমাকে দেখালেন। চোখ ঝলসে গেল। দেরাজের পর দেরাজ, কোনওটায় গলার হার, কোনওটায় কানের দুল, কোনওটায় আর কিছু। একটা আংটির ট্রে তাতে কুড়ি-প’চিশটা হবে-আমার সামনে ধরে বললেন-যেটা খুশি নাও বাবু! আমি বললাম-সে কি কথা। আমার আংটির দাম মোটে ন-সিকে। ওটা আপনাকে প্রেজেন্ট করলুম, সাবধানে রাখবেন, ভেরি হোলি আংটি। আমি, মেম বললেন-ইউ ওল্ড ডিয়ার! কিন্তু তোমার উপহার যদি আমি নিই, আমার উপহারও তোমার ফেরত দেওয়া উচিত নয়। এই ব’লে একটা চুনির আংটি আমার আঙুলে পরিয়ে দিলেন। বললুম-থ্যাংক ইউ মেমসায়েব, আমি আপনার গোলাম, ফরগেট মি নট। মনে মনে বললুম-ভয় নেই ব্রাহ্মণী, এ আংটি তোমার জন্যেই রইল।

ট্রেন এটাওআয় এসে পৌঁছল। কেলনারের খানসামা চা রুটি মাখন নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে-টি হজুর? মেম ট্রে রাখলেন। তারপর আমার লাঠিটা নিয়ে ঢ্যাঙা আর বে’টেকে একটু, গুতো দিয়ে বললেন-গেট আপ টিমি, গেট আপ রটো। তারা বুনো শুয়োরের মতন ঘোঁত ঘোঁত ক’রে কি বললে শুনতে পেলুম না। আন্দাজে বুঝলুম তাদের ওঠবার অবস্থা হয় নি। মেম আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন-চ্যাটার্জি’, তুমি খাবে? আপত্তি নেই তো?

মহা ফাঁপরে পড়া গেল। ফ্লেচ্ছ নারীর স্বহস্তে মিশ্রিত, কিন্তু ভুরভুরে খোশবায়, শাঁতটাও খুব পড়েছে। শাস্ত্রে চা খেতে বারণ কোথাও নেই। তা ছাড়া রেলগাড়ির মতন বৃহৎ কাষ্ঠে ব’সে শীত নিবারণের জন্যে ঔষধার্থে যদি চা পান করা যায় তবে নিশ্চয়ই দোষ নাস্তি। বললুম-ম্যাডাম লক্ষক্ষ্মী, তুমি যখন নিজ হাতে চা দিচ্ছ, তখন কেন খাব না। তবে রুটিটা থাক।

চায়ে মনের কপাট খুলে যায়, খেতে খেতে অনেক বেফাঁস কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অশ্বথামা যেমন দুধের অভাবে পিটুলিগোলা খেয়ে আহহ্লাদে নৃত্য করতেন, নিরীহ বাঙালী তেমনি চায়েতেই মদের নেশা জমায়। বঙ্কিম চাটুজ্যে তারিফ করে চা খেতে শেখেন নি, সর্দি-উর্দি হ’লে আদা-নুন দিয়ে খেতেন, তাতেই লিখতে পেরেছেন-বন্দী আমার প্রাণেশ্বর। আজকাল চায়ের কল্যাণে বাংলা দেশে ভাবের বন্যা এসেছে, ঘরে ঘরে চা, ঘরে ঘরে প্রেম। সেকালের কবিদের বিস্তর বায়নাক্কা ছিল,-উপবন রে, চাঁদ রে, মলয় রে, কোকিল রে। তবে পণ্যশর ছুটবে। এখন কোনও কঙ্কাট নেই, চাই শুধু দুটো হাতল-ভাঙা বাটি, একটু, ছেড়া অয়েল ক্লথ, একটা কেরোসিন কাঠের টেবিল, দু’ধারে দুই তরুণ-তরুণী, আর মধ্যিখানে ধূমায়মান কেতলি। ভাগ্যিস বয়েসটা ষাট, তাই বেঁচে গিয়েছিলুম।

মেমকে জিজ্ঞাসা করলুম-আচ্ছা মেমসায়েব, এই যে দুই হজুর গড়াগড়ি যাচ্ছেন, এ’রা দুজনেই তো আপনার পাণিপ্রার্থী। আপনি কোন ভাগ্যবানটিকে বরণ করবেন?

মেম বললেন-সে একটি সমস্যা। আমি এখনও মনস্থির করতে পারি নি। কখনও মনে হয় টিমিই উপযুক্ত পাত্র, বেশ লম্বা সুপুরুষ, আমাকে ভালও বাসে খুব। কিন্তু মদ খেলেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আর ঐ রুটো, যদিও কেটে মোটা, আর একটু, বয়স হয়েছে, কিন্তু আমার অত্যন্ত বাধ্য আর নরম মন। একটু, মদ খেলেই কেদে ফেলে। বড় মুশকিলে পড়েছি, দুজনেই নাছোড়বান্দা। যা হক এখনও ক-ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে, হাওড়া পৌঁছবার আগেই স্থির ক’রে ফেলব। আচ্ছা চ্যাটার্জি, তুমিই বল না-এদের মধ্যে কাকে বিয়ে করা উচিত।

বললুম-মেমসায়েব, আপনি এ’দের স্বভাবচরিত্র যে প্রকার বর্ণনা করলেন তাতে বোধ হয় দুটিই অতি সুপাত্র। তবে কি না এ’রা যেরকম বেহুশ হয়ে আছেন-মেম বললেন-ও কিছু নয়। একটু পরেই দুজনে চাঙ্গা হ’য়ে উঠবে।

আমি বললুম-আপনার নিজের যদি কোনওটির ওপর বেশী ঝোঁক না থাকে, তবে আপনার বাপ-মার ওপর স্থির করার ভার দিন না?

মেঘ বললেন-আমার বাপ-মা কেউ নেই, নিজেই নিজের অভিভাবক। দেখ চ্যাটার্জি, তোমার ওপরেই ভার দিলুম। তুমি বেশ ক’রে দুটোকে ঠাউরে দেখ। মোগলসরাইএ নেমে যাবার আগেই তোমার মত আমাকে জানাবে। ভেবেছিলুম একটা টাকা ছ’ড়ে চিত-উবুড় করে দেখে মনস্থির করব, কিন্তু তুমি যখন রয়েছ তখন আর দরকার নেই।

ব্যবস্থা মন্দ নয়। আত্মীয়-বন্ধুদের জন্যে এ পর্যন্ত বিস্তর বর-কনে ঠিক ক’রে দিয়েছি, কিন্তু এমন অদ্ভুত পাত্র দেখার ভার কখনও পাই নি। দুজনেই ক্লোরপতি, দুটোই পাঁড়মাতাল। একটা লম্বায় বড়, আর একটা ওজনে পুষিয়ে নিয়েছে। বিদ্যা-বৃদ্ধির পরিচয় এ যাবৎ যা পেয়েছি তা শুধু ঘোঁত ঘোঁত। চুলোয় যাক, মেমের যখন আপত্তি নেই তখন যেটার হয় নাম বলব। আর যদি বুঝি যে মেম আমার কথা রাখবে, তবে বলব-মা লক্ষনী, মাথা যখন আগেই মুড়িয়েছ তখন বাকী কাজ-টুকুও সেরে ফেল। এই দু-ব্যাটা ভাবী স্বামীকে ঝে’টিয়ে নরকদ্ধ কর।

গল্প করতে করতে বেলা প্রায় সাড়ে নটা হ’য়ে এল। এর পরেই একটা ছোট স্টেশনে গাড়ি থামবে, সেই অবসরে সায়েব-মেমরা হাজরি খেতে খানা-কামরায় যাবে। এতক্ষণ ঠাওর হয় নি, এখন দেখতে পেলুম চা খেয়ে মেমের ঠোঁট ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বুঝলুম রংটি কাঁচা। মেম একটি সোনার কৌটো খুললেন, তা থেকে বেরুল একটি ছোট আরশি, একটি লাল বাতি, একটি পাউডারের পুটুলি। লালবাতি ঠোঁটে ঘ’ষে নাকে একটু পাউডার লাগিয়ে মুখখানি মেরামত ক’রে নিলেন।

গাড়ি থামল। মেম বললেন-চ্যাটার্জি, আমি ব্রেকফাস্ট খেতে চললুম। টিমি আর রটো রইল, এদের দিকে একটু, নজর রেখো, যেন জেগে উঠে মারামারি না করে। যদি সামলাতে না পার তবে শেকল টেনো।

আহা, কি সোজা কাজই দিয়ে গেলেন! প্রায় আধ ঘণ্টা পরে কানপুরে গাড়ি থামবে, তখন মেম আবার এই কামরায় ফিরে আসবেন। ততক্ষণ মরি আর কি! লাঠিটা বাগিয়ে নিয়ে ফের দুর্গানাম জপ করতে লাগলুম।

ঢ্যাঙা সায়েবটা উঠে বসেছে। হাই তুললে, চোখ রগড়ালে, আঙুল মটকালে। আমার দিকে একবার কটমট ক’রে চাইলে, কিন্তু কিছু বললে না। টলতে টলতে বাথরুমে গেল।

ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল

তখন বে’টেটা তড়াৎ করে উঠে কোলা ব্যাঙের মতন থপ ক’রে আমার পাশে এসে বসল। আমি ভয়ে চে’চাতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু তার আগেই সে আমার হাতটা নেড়ে দিয়ে বললে-গুড মর্নিং সার, আমি হচ্ছি ক্রিস্টফার কলম্বস রটো।

আমি সাহস পেয়ে বললুম-সেলাম হুজুর।

-আমার দশ কোটি ডলার আছে। প্রতি মিনিটে আমার আয়-

-হজুর দুনিয়ার মালিক তা আমি জানি।

রটো আমার বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বললে-লুক হিয়ার বাবু, আমি তোমাকে পাঁচ টাকা বকশিশ দেবো।

-কেন হুজুর।

-মিস জিল্টারকে তোমার রাজী করাতেই হবে। আমি তোমাদের সমস্ত কথা শুনেছি। তোমারই ওপর সমস্ত ভার, তুমিই কন্যাকর্তা। ঐ টিমথি টোপার-ও অতি পাজী লোক, ওর সমস্ত সম্পত্তি আমার কাছে বাঁধা আছে। ও একটা গাঁড়-মাতাল, পপার, ওর সঙ্গেঙ্গ বিয়ে হ’লে মিস জিল্ল্টার মনের দুঃখে মারা যাবেন।

এই বলে রুটো ফাঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। একটা বোতলে একটু, তলানি পড়ে ছিল, সেটুকু খেয়ে ফেলে বললে-বাবু, তুমি জন্মান্তর মান?

-মানি বইকি।

-আমি আর জন্মে ছিলাম একটি তষিত চাতক পক্ষী, আর এই মেম ছিল একটি রূপসী পানকৌড়ি। আমরা দুটিতে- এমন সময় বাথরুমের দরজা নড়ে উঠল। ব্লটো তাড়াতাড়ি আমাকে পাঁচ আঙুল দেখিয়ে ইশারা ক’রেই ফের নিজের জায়গায় শুয়ে নাক ডাকাতে লাগল।

ঢ্যাঙা সায়েব-মেম যাকে টিমি বলে-ফিরে এসে নিজের বেঞ্চে গ্যাঁট হয়ে তখন ব্লটো জেগে ওঠার ভান করে হাই তুললে, চোখ রগড়ালে, আমার দিকে একবার করুণ নয়নে চেয়ে বাথরুমে ঢুকল। বসল।

এবার টিমির পালা। রটো স’রে যেতেই সে কাছে এসে আমার হাতটা চেপে ধরলে। আমি আগে থাকতেই বললুম-গুড মর্নিং সার।

টিমি আমার হাতটায় ভীষণ মোচড় দিলে।

বললুম-উঃ!

টিমি বললে-তোমার হাড় গুড়ো ক’রে দেব।

ভয়ে ভয়ে বললুম-ইয়েস সার।

-তোমায় থেতলে জেলি বানাব।

-ইয়েস সার।

-মিস জোন জিল্টারকে আমি বিয়ে করবই। আমি সমস্ত শুনেছি। যদি আমার হয়ে তাকে না বল তবে তোমাকে বাঁচতে হবে না।

-ইয়েস সার।

-আমার অগাধ সম্পত্তি। পাঁচটা হোটেল, দশটা জাহাজ কোম্পানি, পচিশটা শুটকী শুওরের কারখানা। রটোর কি আছে? একটা মদের চোরা ভাঁটি, তাও আমার ঢাকায়। ব্লটো একটা হতভাগা মাতাল বে’টে বজ্জাত- রটো বোধ হয় আড়ি পেতে সমস্ত শুনছিল। হঠাৎ কামরায় ছুটে ফিরে এসে ঘুষি তুলে বললে, কে হতভাগা, কে মাতাল, কে বেটে বজ্জাত?

সকলেরই বিশ্বাস যে গান আর গালাগালি হিন্দীতেই ভাল রকম জমে। হিন্দী গালাগালের প্রসাদগুণ খুব বেশী তা স্বীকার করি। কিন্তু যদি নিছক আওয়াজ আর দাপট চাও তবে বিলিতী গাল শুনো-বিশেষ করে মার্কিনী গাল। এক-একটি লব্‌জ যেন তোপ, কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশে। ইংরিজী আমি ভাল জানি না, সব গালাগালির অর্থ বুঝতে পারি নি, কিন্তু তাতে রসগ্রহণের কিছু মাত্র বাধা হয় নি।

দেখলুম এক বিষয়ে সায়েবরা আমাদের চেয়ে দুর্বল-তারা বাগযুদ্ধে বেশীক্ষণ চালাতে পারে না। দু-মিনিট যেতে না যেতেই হাতাহাতি আরম্ভ হ’ল। আমি হতভম্ভ হ’য়ে দেখতে লাগল,ম, গাড়ি কখন কানপুরে এসে থামল, তা টের পাই নি।

হনহন ক’রে মেমসাহেব এসে পড়ল। এই গজ-কচ্ছপের লড়াই থামানো কি তার কাজ? বললে-টিমি ডিয়ার, ডোন্ট-ব্লটো ডারলিং, ডোন্ট-প্লিজ প্লিজ ডোন্ট। কিছুই ফল হ’ল না। আমি বেগতিক দেখে গাড়ি থেকে নেমে ছুটলুম।

ফাস্ট সেকেন্ড ক্লাস সমস্ত খালি। ডাইনিং কারে সকলে তখনও খানা খাচ্ছে। কাকে বলি? ওই যে-একটা সাদা ফ্লানেলের পেন্টুলুন-পরা সায়েব প্লাটফর্মে পাই-চারি ক’রে শিস দিচ্ছে। হন্তদন্ত হ’য়ে তাকে বললুম-কাম্ সার, লেডির মহা বিপদ। সায়েব হশ করে একটি জোর শিস দিয়ে আমার সঙ্গে ছুটল।

হাতাহাতি আরম্ভ হ’ল

মেম তখন আমার লাঠিটা নিয়ে অপক্ষপাতে দু-ব্যাটাকেই পিটছিলেন। কিন্তু তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই, সমানে ঝুটোপুটি করছে। আগন্তুক সায়েবটি মেমকে জিজ্ঞাসা করলে-হেলো জোন, ব্যাপার কি? মেম তাড়াতাড়ি ব্যাপার বুঝিয়ে দিলেন। সাহেব টিমি আর রটোকে থামাবার চেষ্টা করলে, কিন্তু তারা তাকেই মারতে এল। নতুন সায়েবের তখন হাত ছুটল।

বাপ, কি ঘুষির বহর? টিমি ঠিকরে গিয়ে দরজায় মাথা ঠুকে প’ড়ে চতুর্দশ ভুবন অন্ধকার দেখতে লাগল। রটো কোঁক ক’রে বেঞ্চের তলায় চিতপাত হ’য়ে পড়ল। বিলকুল ঠান্ডা।

একটু জিরিয়ে নিয়ে মেম আমার সঙ্গে নতুন সায়েবটির পরিচয় করিয়ে দিলেন -ইনি বিখ্যাত মিস্টার বিল বাউণ্ডার, খুব ভাল ঘুষি লড়তে পারেন। আর ইনি মিস্টার চ্যাটার্জি, ভেরি ডিয়ার ওল্ড ফ্রেড।

সায়েব আমার মুখখানা দেখে বললে-সাম্ বিয়ার্ড’!

মেম বললেন-থাকুক দাড়ি। ইনি অতি জ্ঞানী লোক।

সায়েব আমার হাতটা খুব করে নেড়ে দিয়ে বললে-হা-ডু-ডু? বেশ শ্রীত পড়েছে নয়?

ধাঁ করে আমার মাথায় একটা মতলব এল। মেমসায়েবকে চুপি চুপি বললন -দেখুন মিস জোন, অত গোলমালে কাজ কি? টিমি আর ব্লটো দুজনেই তো কাব হ’য়ে পড়েছে। আমি বলি কি-আপনি এই বিল সায়েবকে বিয়ে করুন। খাসা

লোক মেম বললেন-রাইটো। আমার একথা এতক্ষণ মনেই পড়ে নি। আই সে বিল, আমায় বিয়ে করবে?

বিল বললে-রাদার। কে বলে আমি করব না?…

রাধামাধব। সায়েব জাতটা ভারী বেহায়া। বিলকে বাধা দিয়ে বললুম-রোসো সায়েব, এক্ষুনি ও সব কেন। আমি হচ্ছি ব্রাইডমাস্টার-কন্যাকর্তা। তোমার কুলশীল আগে জেনে নি, তার পর আমি মত দেব।

‘ঠোঁটের সি’দূর অক্ষয় হোক’

বিল বললে-আমার ঠাকুরদা ছিলেন মুচি। সেলাই করতেন। আমার বাপও ছেলেবেলায় জুতো

আমি বললুম-তাতে কুলমর্যাদা কমে না। তোমার আয় কত?

বিল একটু, হিসেব করে বললে-মিনিটে দশ হাজার, ঘন্টায় ছ লাখ। কিন্তু চিন্তা করবেন না, আমার মাসী মারা গেলে আয় আর একটু বাড়বে। তাঁর প’চিশটা বড় বড় পুকুর আছে, নোনা জলে ভরতি, তাতে তিমি মাছ কিলবিল করছে।

বললুম-থাক, আর বলতে হবে না, আমি মত দিলুম। এগিয়ে এস, আমি আশীর্বাদ করব, রিয়াল হিন্দু স্টাইল।

কিন্তু ধান-দুব্বো কই? জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বললুম-এই কুলী, জলদি থোড়া ঘাস ছিড়কে লাও, পয়সা মিলেগা।

ইংরিজী আশীর্বাদ তো জানি না। বললুম-যদি আপত্তি না থাকে তবে বাংলাতেই বলি।

-নিশ্চয়, নিশ্চয়।

সাহেবের মাথায় এক মুঠো ঘাস দিয়ে বললুম-বে’চে থাক। ধন তো যথেষ্ট আছে, পুত্রও হবে, লক্ষনী এই স’পে দিলুম। কিন্তু খবরদার ব্যাটা, বেশী মদ-টদ খেয়ো না, তা হ’লে ব্রহ্মশাপ লাগবে। সাহেব আর একবার আমার হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে নড়া ছিড়ে দিলে।

মেমকে বললুম-মা লক্ষনী, তোমার ঠোঁটের সিন্দুর অক্ষয় হ’ক। বীরপ্রসবিনী হ’য়ে কাজ নেই মা-ও আশীর্বাদটা আমাদের অবলাদের জন্যেই তোলা থাক। তুমি আর গরিব কালা-আদমীদের দুঃখের নিমিত্ত হয়ো না,-গুটিকতক শান্তশিষ্ট কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে ঘরকন্না কর।

মেম হঠাৎ তার মুখখানা উচু করে আমার সেই পাঁচ দিনের খোঁচা-খোঁচা দাড়ির ওপর-‘

বিনোদবাবু, বলিলেন-‘আ ছি ছি ছি।’

চাটুজ্যেমশায় বলিলেন-হ, দেবীচৌধুরানীতে ঐ রকম লিখেছে বটে।’

‘আচ্ছা চাটুজ্যেমশায়, পাকা লঙ্কার আম্বাদটা কি রকম লাগল?’

‘তাতে ঝাল নেই। আরে, ঐ হ’ল ওদের রেওয়াজ, ঐ রকম ক’রেই ভক্তিশ্রদ্ধা জানায়, তাতে লজ্জা পাবার কি আছে।’

চাটুজোমশায় বলিতে লাগিলেন-‘তারপর দেখি ঢ্যাঙা আর বে’টে মুখ চুন ক’রে নেমে যাচ্ছে, জন-দুই কুলী তাদের মালপত্র নামাচ্ছে।

গাড়ি ছাড়ল। বিল আর জোন হাত ধরাধরি ক’রে নাচ শুরু ক’রে দিলে। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখতে লাগলুম।

জোন বললে-চ্যাটার্জি, এই আনন্দের দিনে তুমি অমন ‘লাম হ’য়ে বসে থেকো না। আমাদের নাচে যোগ দাও।

বললুম-মাদার লক্ষক্ষ্মী, আমার কোমরে বাত। নাচতে কবিরাজের বারণ আছে। -তবে তুমি গান গাও, আমরাই নাচি!

কি আর করা যায়, পড়েছি যবনের হাতে। একটা রামপ্রসাদী ধরলুম।

সমস্ত পথটা এই রকম চলল, অবশেষে মোগলসরাই এল। মেম বললে, কলকাতার গিয়েই তাদের বিয়ে হবে, আমি যেন তিন দিন পরে গ্রান্ড হোটেলে অতি অবশ্য তাদের সঙ্গে দেখা করি। বিস্তর শেকহ্যান্ড, বিস্তর অনুরোধ, তারপর নেমে কাশীর গাড়ি ধরলুম।… পরদিন আবার কলকাতা যাত্রা।’

নাচ শুরু ক’রে দিল

বিনোদবাবু, বলিলেন-‘আচ্ছা চাটুজ্যেমশায়, গিন্নী সব কথা শুনেছেন?’

‘কেন শুনবেন না। সতীলক্ষর্মী, তায় পঞ্চাশ বছর বয়স হয়েছে। তোমাদের নবীনাদের মতন অবুঝ নন যে অভিমানে চৌচির হবেন। আমি বাড়ি ফিরে এসেই তাঁকে সমস্ত বলেছি।’

‘চাটুজোগিন্নী শুনে কি বললেন?’

‘তক্ষুনি একটা উড়ে নাপিত ডেকে বললেন-‘দে তো রে, বুড়োর মুখখানা আচ্ছা ক’রে চে’চে, স্লেচ্ছ মাগী উচ্ছিষ্টি ক’রে দিয়েছে!’ তারপর সেই চুনির আংটিটা কেড়ে নিয়ে গঙ্গাজলে ধুয়ে নিজের আঙুলে পরলেন।’

‘বউভাতের ভোজটা কি রকম খেলেন?’

‘সে দুঃখের কথা আর না-ই শুনলে। গ্রান্ড হোটেলে গিয়ে জানলুম ওরা কেউ নেই। একটা খানসামা বললে-বিয়ের পরদিনই বেটী পালিয়েছে। সায়েব তাকে খু’জতে গেছে।’

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024