আবু ইসহাক
আরবির শিক্ষক মৌলবি সাহেব দশম শ্রেণীর আরবির ক্লাস নিতে আসছেন। তাঁর এক হাতে আরবির পাঠ্য বই, অন্য হাতে বেত। ১৯৪১ সালের কথা। সে সময়ে পড়া না পারলে বা কোনো অন্যায় করলে প্রহার করার জন্য শিক্ষকগণ বেত ব্যবহার করতেন। এখনও নাকি বাংলাদেশের কোনো কোনো স্কুলে
প্রহারের জন্য বেত ব্যবহার করা হয়। মৌলবি সাহেব কক্ষে প্রবেশ করতেই ইলিয়াস ও তার তিন সহাধ্যায়ী দাঁড়িয়ে প্রায় একসাথে তাঁকে সালাম দেয়, আস্-সালামু আলায়কুম।
-ওয়ালাইকুম আস্-সালাম।
তিনি চেয়ারে বসে বলেন, তোদের যে হেকায়েতটা পড়ে আসতে বলেছিলাম তা পড়ে এসেছিস?
-স্যার হেকায়েতের আরবিতে হরকত না থাকায় পড়তে ভীষণ অসুবিধে হয়। আর পড়তে পারি না বলে গল্পটা ভালো করে বুঝতেও পারি না। ইলিয়াস বলে।
-হ্যাঁ, আরবি ভাষা ভালো করে না শিখলে এই অসুবিধা হবে। তোরা পেন্সিল হাতে নে। আমি আস্তে আস্তে পড়ে যাব, তোরা হরকত বসিয়ে নিবি।
হরকত অর্থাৎ স্বরচিহ্ন। বাংলায় যেমন আ-কার, ই-কার, উ-কার ইত্যাদি আছে, আরবিতে তেমনি আছে জবর, জের, পেশ। এই হরকত লিখিত আরবি ভাষায় ব্যবহার করা হয় না। কোনো ক্রিয়াপদের কর্তৃবাচ্য লিখতে যে-সব অক্ষর ব্যবহৃত হয়, কর্মবাচ্য লিখতেও সে-সব অক্ষরই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু উচ্চারণ ভিন্ন। মাতৃভাষা যাদের আরবি, তারা হরকতবিহীন অক্ষর দিয়ে তৈরি বাক্যে ব্যবহৃত শব্দের অর্থ জানে বলেই সঠিক উচ্চারণ করতে পারে। এ যেন বাংলাদেশে সুপ্রচলিত গল্পের এক বালকের চিঠির মতো। শুধু অ-আ-ক-খ লিখতে শিখেছে এমন এক বালক তার নিরক্ষর মায়ের নির্দেশে তার বাবার কাছে চিঠি লিখেছে বব টক পঠনত গঠন নপঠনত ভতর অভব মর যব। মাতৃভাষায় স্বরচিহ্নবিহীন এ চিঠি বালকের পিতা ঠিকই বুঝেছিলেন: বাবা, টাকা পাঠান তো পাঠান, না পাঠান তো ভাতের অভাবে মারা যাব। যে-সব আরবি শিক্ষার্থীর মাতৃভাষা আরবি নয়, তাদের পক্ষে হরকতবিহীন আরবি শব্দ উচ্চারণ করা খুবই কঠিন। একমাত্র পবিত্র কোরান-এ হরকত ব্যবহৃত হয়। তাই পৃথিবীর সব দেশের সব ভাষাভাষী লোকেরাই অর্থ না জেনেও উচ্চারণ-বিকৃতি না ঘটিয়ে উক্ত পবিত্র গ্রন্থ পড়তে পারে।
মৌলবি সাহেব ধীরে ধীরে থেমে থেমে পড়ে যাচ্ছেন আর তাঁর সব ছাত্র পেন্সিল দিয়ে আরবি অক্ষরের উপরে জবর বা পেশ এবং নিচে জের বসিয়ে নিচ্ছে।
হরকত বসানোর পর মৌলবি সাহেব কিছু কিছু শব্দের বাংলা অর্থ বলে দেন। ছাত্ররা তা লিখে নেয়। তিনি বলেন, হেকায়েত অর্থ গল্প। আজকের হেকায়েতটা কিন্তু বানানো গল্প নয়। তারপর তিনি বাংলায় হেকায়েতটি বয়ান করতে শুরু করেন: এক নাস্তিক বাগদাদের খলিফার দরবারে গিয়ে তাঁর পারিষদদের কাছে বলে, “আপনারা সৃষ্টিকর্তারূপে যে আল্লাহর এবাদত করেন, তার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি যুক্তি দিয়ে তা প্রমাণ করে দেব। আপনারা মহামান্য খলিফাকে খবর দিন। তিনি যেন তাঁর দেশের আলিমদের ডেকে পাঠান। আমি তাঁদের সাথে বাহাছ করব।”
খলিফার নির্দেশে দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ আলিম ও বিশিষ্ট আলিমদের দরবারে আসার জন্য সংবাদ পাঠানো হয়।
তর্কযুদ্ধের খবর পেয়ে বাগদাদের বহু গণ্যমান্য লোক এসে জমায়েত হন খলিফার দরবারের বিশাল মিলনায়তনে। তাঁরা অশেষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আমন্ত্রিত সব আলিম এসে গেছেন, কিন্তু যিনি এলে তর্কযুদ্ধ শুরু হবে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ আলিম আসেন নি।
অনেক সময় পেরিয়ে যায়। নাস্তিক অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সে দাঁড়িয়ে বলে,-কোথায় আপনাদের আলিম-ই-আজম? তিনি কি আমার সাথে বাহাছ করতে চান না? মনে হচ্ছে, বাহাছ করে হেরে যাবেন বুঝতে পেরে তিনি আসছেন না ?
আরো অনেক সময় পেরিয়ে যায়।
নাস্তিক আবার ওঠে দাঁড়িয়ে বলে, আপনাদের আলিম-ই-আজম এখনও এলেন না। তিনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, তিনি আমার সাথে বাহাছ করে হেরে যাবেন। তাই তিনি আসবেন বলে মনে হয় না।
আরো কিছু সময় পর সর্বশ্রেষ্ঠ আলিম দরবারে এসে হাজির হন। সমবেত দর্শক- শ্রোতা হাততালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান।
সর্বশ্রেষ্ঠ আলিম আসার পর মহামান্য খলিফা সপারিষদ দরবারে আসেন। দরবারের সবাই দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসেন। তাঁর ডানে, বাঁয়ে, পেছনে বসেন তাঁর পরামর্শদাতা ও পারিষদবর্গ।
এবার তর্কযুদ্ধ, শুরু হবে। দর্শক-শ্রোতা নড়েচড়ে বসেন।
নাস্তিক দাঁড়িয়ে আলিম-ই-আজমকে সম্বোধন করে অনুযোগের স্বরে বলে,-আপনাকে এই দেশের মানুষ আলিম-ই-আজম বলে মান্য করে। সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে গেছে। এই দরবারে আসতে আপনার এত দেরি হওয়ার তো কথা নয়।
-সত্যি আমার আসতে খুব দেরি হয়ে গেছে। আলিম-ই-আজম বলেন। -কিন্তু কী করব, আমি থাকি দাজলা নদীর ওপারে। নদীর পাড়ে এসে দেখি একটা নৌকাও সেখানে নেই। নদীর পাড়ে পড়ে আছে কয়েকটা তক্তা। হঠাৎ দেখি, তক্তাগুলো একটার সাথে আর একটা জোড়া লাগতে শুরু করছে। কোনো মিস্ত্রি ছাড়াই সবগুলো তক্তা একসাথে জোড়া লাগার পর একটা নৌকা তৈরি হয়ে গেল। সেই নৌকা চড়ে নদী পার হয়ে আমি এখানে এসেছি। এজন্যেই আমার আসতে দেরি হয়ে গেছে।
নাস্তিক দাঁড়িয়ে বলে, শুনলেন তো মহামান্য খলিফা। আপনার দেশের আলিম-ই-আজম কী বললেন? তক্তা কখনো নিজে নিজে জোড়া লাগতে পারে? কোনো মিস্ত্রি ভাড়া এভাবে নৌকা তৈরি হতে পারে?
আলিম-ই-আজম উচ্চকণ্ঠে বলেন,-রে কাফের, তক্তা যদি নিজে নিজে জোড়া লাগতে না পারে, মিস্ত্রি ছাড়া যদি নৌকা তৈরি হতে না পারে, তা হলে এই চন্দ্র-সূর্য-পৃথিবী কীভাবে তৈরি হয়েছে? মানুষ-পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, গাছ-গাছড়া কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে? এইসব কি একজন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে বলতে চাও? তা কি সম্ভব?
কক্ষনো না। অতএব সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ আছেন এবং তিনিই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। দরবারের সবাই হাততালি দিয়ে তাঁকে সমর্থন জানান।
নাস্তিক আর কোনো জবাব দিতে পারে না।
খলিফার নির্দেশে তখনই নাস্তিকের শিরশ্ছেদ করা হয়।
মৌলবি সাহেব তাঁর বয়ান শেষ করে বলেন, তোরা শুনলি তো যুক্তির প্যাঁচে পড়ে নাস্তিকটা কেমন ঘায়েল হয়ে গেল! লোকটা যেমন বেহুদা বাহাছ করতে এসেছিল তেমনি তার উচিত সাজা হয়েছে।
ইলিয়াস দাঁড়িয়ে বলে, স্যার, নাস্তিক লোকটা ছিল বোকা।
-হ্যাঁ, বোকার বোকা, নিরেট বোকা। বোকা না হলে কেউ ‘সৃষ্টিকর্তা নেই’ প্রমাণ করার জন্য বাহাছ করতে আসে!
-কিন্তু নাস্তিক লোকটা যদি পালটা প্রশ্ন করত,-আলিম-ই-আজম, আপনি তো বললেন, স্রষ্টা ছাড়া কোনো সৃষ্টি হয় না। তা হলে বলুন, আপনার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছে?
মৌলবি সাহেব টেবিল থেকে বেতটা নিয়ে বর্শার মতো ইলিয়াসের দিকে ছুঁড়ে মারেন জোরে এবং চিৎকার দিয়ে বলেন, ফি না-রে জাহান্নাম।
ইলিয়াস বেতটা লুফে না ধরলে ওটা তার মুখে আঘাত হানত।
মৌলবি সাহেব রাগে গড়গড় করতে করতে বলেন, তুই জাহান্নামের লাকড়ি। শোন, শুনে রাখ, আল্লাহ্ এক ও সর্বশক্তিমান, তিনি নিরাকার এবং সর্বত্র বিরাজমান। নিরাকার বলে তাঁকে সৃষ্টি করার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন। তাই তাঁর সম্বন্ধে এরকম না-জায়িজ সওয়াল-ধর্মবিরুদ্ধ প্রশ্ন কক্ষনো করতে নেই।