মীর আব্দুল আলীম
আধুনিক জীবনের নতুন বিপদ: খাবারে নীরব মৃত্যু
এক সময় মানুষ আত্মহত্যা করত প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা আর্থিক কষ্টে। এখন আর বিষ খেতে হয় না, বিষ মেশানো থাকে আমাদের প্রতিদিনের খাবারে। আধুনিক যুগে খাবার হয়ে উঠেছে এক নীরব ঘাতক — যেখানে ভাত, মাছ, সবজি মানেই এখন ফরমালিন, কার্বাইড, সোডিয়াম সাইক্লামেট, বোরিক অ্যাসিড আর অচেনা সব রাসায়নিকের মিশ্রণ। এককথায়, মাছ-ভাতে বাঙালি এখন বাঁচে বিষ-ভাতে।
রোগে ভরা সমাজ, কারণ একটাই — ভেজাল খাবার
দেশজুড়ে বাড়ছে ক্যান্সার, কিডনি ও ফুসফুসের রোগ। ছোট শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে ব্লাড ক্যান্সারে। যাদের হারানোর কথা ছিল না, তারা হারিয়ে যাচ্ছে অকালেই। কারণ প্রতিদিন আমরা যা খাচ্ছি, তাতে বিষ মেশানো — এবং সেটাই অজান্তেই আমাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বাজারে ‘ফরমালিনে ফ্রেশ’ মাছ ও উজ্জ্বল রঙের সবজি
আগে মাছ পচে যেত, এখন ফরমালিনে ডুবিয়ে তা টিকিয়ে রাখা হয় দিনের পর দিন। লালচে চিংড়ি মাছ, ঝকঝকে সবজি — সবই যেন রঙিন মৃত্যুর উৎস। ভাতে মেশানো হচ্ছে পটাশিয়াম ব্রোমেট, তেলে আছে অক্সিডাইজড কেমিক্যাল, আর গন্ধ থাকলেই সেটা ভালো বলে ধরে নিচ্ছি — যা সবসময় সত্য নয়।
‘অর্গানিক’ প্রতারণা ও ‘ভেজাল ভালোবাসা’
বাজারে ছড়াছড়ি “অর্গানিক” পণ্যের — অর্গানিক চাল, আম, রসগোল্লা। কিন্তু বাস্তবে এগুলোর উৎপত্তি হয় কোনো লোকাল হোমিও ল্যাব থেকে। কিছু পণ্যে ব্যবহৃত হয় ‘প্রাকৃতিক হাইড্রোজেনেটেড সুগার সাবস্টিটিউট’ — শুনলেই প্রেশার বাড়ে!
আইন আছে, প্রয়োগ নেই — এটাই মূল সমস্যা
দেশে বহু আইন রয়েছে ভেজাল প্রতিরোধে — ১৯৫৯ সালের খাদ্য আইন, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন, বিএসটিআই-এর মান নিয়ন্ত্রণ নিয়মাবলি — সবই আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই। ১৪ বছরের কারাদণ্ড, এমনকি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও বাস্তবে শাস্তি পাওয়া গেছে এমন নজির নেই বললেই চলে।
প্রতারণা চেনা চেনা খেলা: ‘মায়ের দোয়া সুগার’!
অভিযান চালিয়ে দোকানে ভেজাল ধরা পড়ে — যেমন চিনিতে কাপড়ের রং। তারপর এক কাপ চা, কিছু ‘সমঝোতা’, দোকানদারের মাফ চাওয়া — আর পরদিনই সেই একই চিনি ‘নতুন নাম’ নিয়ে বাজারে!
বিএসটিআই, ক্যাব ও বাস্তবতার ফারাক
দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার সরঞ্জামও চালাতে হিমশিম খায়। ল্যাব নেই, যন্ত্রপাতি নেই, দক্ষ লোকবল নেই — অথচ দায়িত্ব আকাশসম। ক্যাব বলছে, ঢাকার ৭০% হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারে ভেজাল! কিন্তু মানুষ পরোটা-ভাজি খেতেই যায়, কারণ অভ্যাস আর খিদে বড় শক্তি।
শিশুদের শরীরে বিষ ঢুকছে প্রতিদিন
শহর-গ্রামে শিশুদের মধ্যে বাড়ছে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, লিভার ডিজঅর্ডার। কারণ: দুধে হাইড্রোজেনেটেড ফ্যাট, নুডলসে প্রিজারভেটিভ, চিপসে সোডিয়াম গ্লুটামেট। শিশুর শরীর যেন গঠিত হচ্ছে কৃত্রিম প্লাস্টিক দিয়ে!
আসলে আমরা খাচ্ছি কী?
এই প্রশ্ন আমরা নিজের কাছে কবে করেছি? বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিদিনের খাবারে আছে কমবেশি বিষ। মাছের বাজারে মাছি নেই, ভাত খেলে বমি হয়, পোলাওয়ে স্বাদ নেই — সবই এর প্রমাণ। আমরা ধীরে ধীরে বিষ খেয়ে যাচ্ছি, নীরবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
বাঁচার পথ কী?
আমরা যদি এখনই কিছু না করি, তাহলে ভবিষ্যতের শোকবার্তা হবে:
“তিনি ৪০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, কারণ সকালে খেয়েছিলেন এক প্লেট খিচুড়ি!”
যা করতে হবে: ১. ভেজালবিরোধী কঠোর আইন এবং তার কার্যকর প্রয়োগ
২. গণসচেতনতা ও ভোক্তা আন্দোলন
৩. মিডিয়া নজরদারি, আধুনিক ল্যাব ও জনবল
৪. দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ আদালত
শেষ কথা: খাবার নয়, চাই নিরাপদ জীবন
দুধে দুধ নেই, পেঁয়াজে পেঁয়াজ নেই — এমন খবর আমরা আর চাই না।
ভেজালের বিরুদ্ধে সবাইকে একসাথে লড়তে হবে — জনগণ, প্রশাসন, ব্যবসায়ী, মিডিয়া এবং সরকার।
নইলে একদিন বলতেই হবে: “বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিন্তু নিরাপদ খাদ্যে অনাহারী!”
আমরা যারা এই সমাজের অংশ — চলুন, অন্তত এই বিষময় মৃত্যুর বিরুদ্ধে দাঁড়াই।
মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক ও সমাজ গবেষক