বড়ু
ওরা গরিব। কতই অসহায়। কুৎসার হাত হইতে ওরা নিজেদের রক্ষা করিতে পারিবে না। সেদিন চলিয়া যায়। তার পরের দিনও চলিয়া যায়। আমার বুকের নিশ্বাসের মতো রাত যেন শেষ হইতে চাহে না। তবু রাত শেষ হইল। আরও একটু বেলা হইলে বজ্রদের বাড়ি যাইব। লস্কর তালুকদারের বাড়ির পাশ দিয়া নদীর ধার দিয়া পথ যাইয়া মিশিয়াছে শ্মশানঘাটের রাস্তায়। দূরে ওই পাশে হদা মল্লিকের তালগাছ তারপরে আজিম মল্লিকের বাড়ি। তাদের উঠান পার হইলেই বড়ুদের বাড়ি। চারিদিক নীরব থমথম। কেহ কোনো কথা বলে না। বস্তুদের উঠানে কয়েকটি খণ্ড খণ্ড কলাগাছ। ওপাশে সদ্যখোদিত মাটির কবর। আমগাছের ঘন ছায়া সেখানে অন্ধকার বিস্তার করিয়া আছে। উঠানে আসিতেই চাচি হামলাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। “আমার বড়ু আমাকে ছাড়িয়া চিরজনমের মতো চলিয়া গিয়াছে।”
তিনদিন আগে তার প্রসববেদনা উঠিয়াছিল। গ্রাম্য হাতুড়ে দাই, ওঝা তাদের যতটা সাধ্য মন্ত্র-তন্ত্র করিয়াছে। কিছুতেই কিছু হইল না। “জবাইকরা মুরগির মতো মা আমার গত তিনদিন ধরিয়া কেবল ছটফট করিয়াছে। আমাকে কাছে ডাকিয়া হাত দু’খানা বুকে জড়াইয়া ধরিয়াছে। মাকে বলিয়াছি, ‘আমি অভাগিনীর হাতে তো আল্লা এমন কোনো দাওয়াই লেখেন নাই, যে তোর সকল দুঃখের উপশম হইবে। মারে। সবুর করিয়া থাক্। চুপ করিয়া সহ্য কর।’ চুপ করিতে করিতে মা আমার চিরজনমের মতো চুপ হইয়া গেল।” এই বলিয়া চাচি ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। খানিক কাঁদিয়া চাচি আবার বলিতে লাগিল, “মরণেও মার গায়ের বন্নক এতটুকু মৈলাম হয় নাই। মায়ের আমার সোন্দলের মতো হাত-পা, পিরদিমির মতো চোখ-মুখ। সকলে মাকে যখন নাওয়াইয়া-ধোয়াইয়া গোরের কাফন পরাইয়া লইয়া গেল তখন যদি দেখিতে বাবা-মা যেন সাজিয়া-গুজিয়া বেড়াইতে বাহির হইল!”
চাচির উঠানে কতক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া বস্তুর কবরের কাছে আসিলাম। মুক মাটির কবর কথা বলে না। আমার মনের সান্ত্বনা তাই মাটি খুঁড়িয়া বাহির হইল না। আজ বড়ুর কবরের পাশে বসিয়া দুই ফোঁটা চোখের জল ফেলিবারও সাধ্য আমার নাই। আমি তাহার কে, যে তাহার কবরে বসিয়া চোখের জল ফেলিব? জীবনে যাহাকে কোনোদিন নিজের মনের আকুতি জানাই নাই পাছে লোকে তাকে কিছু বলে; আজ তার কবরের পাশে বসিয়া অশ্রুবিসর্জন করিয়া তার সেই শুভ্র পবিত্র জীবনে কেন কালিমা লেপন করি? পায়ের উপর পা ফেলিয়া নদীর ধারে আসিয়া বসিলাম। নদীতে আর কতটুকু পানি ধরে যে আমার অশ্রুধারার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিবে? কত কথাই মনে আসিতে লাগিল। আমি কেন বাড়ি আসিয়াই বড়ুকে দেখিতে গেলাম না? আমি বাড়ি আসিবার পরেও বড়ু দুই-তিনদিন জীবিত ছিল।
আল্লা যাহাকে লইয়া যান কেহ তাহাকে ফিরাইতে পারে না। আহা! দশজনের মতো যদি এই কথা বিশ্বাস করিতে পারিতাম! জীবনে কত লোকের অসুখে কত রাত জাগিয়াছি, কতজনের জন্য ডাক্তার ডাকিয়া আনিয়াছি-ঔষধ কিনিয়া দিয়াছি। বস্তুর এই বিপদের দিনে আমি তার কোনো কাজেই আসিতে পারিলাম না। মৃত্যু-যন্ত্রণায় কাতর বড়ু কি একবারও আমার কথা ভাবিয়াছিল, সে কি পথের দিকে চাহিয়াছিল, ভাই আসিয়া তাহার সকল যন্ত্রণা দূর করিয়া দিবে? যাহাকে সমস্ত দুনিয়া ধরিয়া দিতে কার্পণ্য করিতাম না, তাহার জীবনের এই চরম ক্ষণে আমি তার কোনো কাজেই আসিলাম না। হয়তো আমার সেবার মধ্যে কোনো কলুষ লুক্কায়িত ছিল। হয়তো আমি তার উপকারের উপযুক্ত ছিলাম না। তাই জীবনের চরম
ক্ষণেও সে আমার কোনো দান গ্রহণ করিল না। চাচি যতদিন বাঁচিয়া ছিল দেশে গেলেই দেখা করিতাম। ছোট মেয়েটিকে লইয়া চাচি
আবার বিয়ের গান গাহিয়া আমাকে খুশি করিতে চেষ্টা করিত। কিন্তু আগের মতো সেই গান আর জমিত না। কয়েক বছর চাচি মারা গিয়াছে। রহিমদ্দীন চাচা এখন বৃদ্ধ। আমাকে দেখিলেই গলা জড়াইয়া ধরিয়া আদর করে। তাহার বাড়ির সেই কাঁঠালগাছটিতে এখনও বুনো পাখি আসিয়া ডাকে। সেখানে বসিয়া ভাবি, আমার জীবনের আপনজনেরা ধীরে ধীরে চলিয়া যাইতেছে। জীবন-নাট্যে যারা অভিনয় করিতে আসিয়াছিল তারা ধীরে ধীরে বিদায় লইয়া যাইতেছে। স্নেহময়ী সদাহাস্যমুখরা দাদি, সোনার প্রতিমা বস্তু, মাতৃরূপিণী চাচি, এরা। কি আর ফিরিয়া আসিবে? বৃদ্ধ রহিমদ্দীন চাচার মাটির প্রদীপটি ধীরে ধীরে নিবিয়া আসিতেছে। হয়তো কোনোদিন খবর পাইব, সেও চলিয়া গিয়াছে। জীবনের আগিলা পথে আরও কতজনের সঙ্গে দেখা হইয়াছে-কতজনের সঙ্গে দেখা হইবে, কিন্তু যারা চলিয়া গিয়াছে তাদের মতো আর কাহাকেও পাইব না।
চলবে…..
Leave a Reply