১৯৭১ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণ‑পশ্চিমাঞ্চলীয় তৎকালীন মহাকুমা শহর মেহেরপুরকে মুজিবনগর ঘোষণা করে, বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে প্রথম বাংলাদেশ সরকার শপথ নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল নেতা ও ১৯৭০‑এর নির্বাচিত সংসদের সংসদীয় দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে ওই সরকার গঠন হলেও, মূলত সেদিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেয়। স্বাধীনতার মূল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী।
যদিও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়েছিল, তার পরেও ১০ এপ্রিল সরকার গঠন, ১৭ এপ্রিল প্রথম সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও তার মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের ভেতর দিয়ে মূলত স্বাধীন দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। আর সেদিনের সেই নতুন দেশের যাত্রার তথ্যনির্ভরতা ও গভীরতা বুঝতে হলে—নতুন প্রজন্মকে ওই অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের দেওয়া ভাষণটির ভিডিওটি দেখা একান্ত প্রয়োজন। একটা মহান বিপ্লব, একটা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় একজন জনপ্রতিনিধি এবং সরকারিভাবে যিনি ওই মুহূর্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান—তিনি কতটা সাদামাটা জীবনের অধিকারী, আবার কত দৃঢ় হতে পারেন—তার উদাহরণ ওই ভাষণ।
আর সরকারের ওই আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্য যাত্রার মধ্য দিয়ে সেদিন বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও তার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ গোটা বিশ্বকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। অন্যদিকে অপর জনপ্রতিনিধি অধ্যাপক ইউসুফ আলী পাঠ করেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা মূলত বাংলাদেশের সংবিধানের মাতৃজননী কোষ। এবং এই ডিক্লারেশন অফ ইনডিপেনডেন্সের ওপর ভিত্তি করেই যেমন তৈরি হয়েছে এ দেশের সংবিধান, তেমনি তার ওপরই ভর করে এগোতে হবে এ সংবিধানকে। আইনগত সকল পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ক্ষেত্রে সংবিধানকে এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই সবকিছু করতে হবে। এর বাইরে গেলেই বাংলাদেশের সাংবিধানিক অস্তিত্ব ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রশ্নের মুখে পড়বে।
আমাদের ইতিহাসের অনেক বইয়ে ১৯৭১‑এর ১৭ এপ্রিলের এই সরকারকে অস্থায়ী সরকার বা প্রবাসী সরকার বলা হয়ে থাকে। এটা সম্পূর্ণ ভুল। বাস্তবে ১৯৭১‑এর ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের যাত্রা, আর বাংলাদেশ ১৭ এপ্রিল সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের দিন।
যে কোনো জাতির নানা সময়ে নানা কারণে ইতিহাসকে নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আসে। কিন্তু ইতিহাসের মৌল উপাদান সব সময়ই কষ্টিপাথরে ঘষা খাঁটি হীরা। একে অস্বীকার ও বদলানোর ক্ষমতা কারও নেই।
আজ এই দিনে বলা যায়, প্রকৃত ঐতিহাসিকেরা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় প্রকৃত তথ্যের ওপর দাঁড় করিয়ে দেবেন, যে আয়নায় জাতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিজেকে যেন সঠিকভাবে দেখতে পায়।