হারুন উর রশীদ স্বপন
জাতিসংঘের প্রস্তাবে বাংলাদেশ রাখাইনে শর্তসাপেক্ষে ‘মানবিক করিডোর’ দিতে সম্মত হয়েছে – বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন৷ বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, করিডোর বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াতে পারে৷
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক মনে করেন, মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির সম্মতির ভিত্তিতে না হলে মানবিক করিডোর বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে৷
রবিবার এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাখাইনে মানবিক করিডোর সম্পর্কে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘‘এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত৷ কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ (মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ) হবে৷ কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলী রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না৷ সেই শর্তাবলী যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করবো৷”
কিন্ত শর্তগুলো যেমন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা খুলে বলেননি, তেমনি পরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সেখানকার দায়িত্বশীল কেউও আনুষ্ঠানিকভাবে ডয়চে ভেলেকে সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেন নি৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শাহ আসিফ রাহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন,” পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মানবিক করিডোরের ব্যাপারে যা বলেছেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে এখনো আমাদের পজিশন পেপার তৈরি হয়নি৷ সেটা হলে আমরা বিস্তারিত জানাতে পারবো৷”
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানান, মোট তিনটি শর্তে জাতিসংঘের প্রস্তাবে রাখাইনে মানবিক করিডোর দিতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ৷ প্রথমত, রাখাইনের যেখানে খাদ্য ও ওষুধসহ মানবিক সহায়তা দেয়া হবে, সেই জায়গায় যেন সহায়ক পরিবেশ থাকে৷ সেখানে যুদ্ধাবস্থা বা সংঘাতময় পরিবেশ থাকলে চলবে না৷ যুদ্ধবিরতি হতে পারে বা বিবাদমান পক্ষগুলো একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে৷ সেটা মিয়ানমার জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যে হতে পারে৷ অথবা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপাস্থিতির মাধ্যমেও নিশ্চিত হতে পারে৷ দ্বিতীয়ত, মানবিক সহায়তা দেয়ায় কোনো বৈষম্য করা যাবে না৷ রাখাইনে রোহিঙ্গা আছে, আরকানিজ আছে- যাদের প্রয়োজন, সবাইকে দিতে হবে৷ তৃতীয়ত, মানবিক সহায়তা হতে হবে শর্তহীন৷ সহায়তা পেতে কাউকে কোনো শর্তের অধীন করা যাবে না৷
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জাতিসংঘের কাছে এই শর্তগুলো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়েছে৷ বাংলাদেশ চাইছে, রাখাইনে যুদ্ধ বন্ধে যেন আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়৷ তাহলে সেখানে মানবিক সহায়তার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে৷
করিডোরটা কোন সীমান্ত দিয়ে হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়৷ তবে ঘুমধুম সীমন্ত দিয়ে এটা সহজ হতে পারে৷
আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মধ্যে সংঘর্ষে রাখাইনের ৮০ ভাগই এখন আরাকান আর্মির দখলে৷ রাখাইনে এখন কোনো ধরনের খাদ্য বা ওষুধ ঢুকতে দিচ্ছে না মিয়ানমার৷ ফলে রাখাইনে এখন ব্যাপক খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষাবস্থা চলছে৷ যদি এই সংকট আরো বাড়ে, তাহলে আরাকানিদের সদলবলে বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা আছে৷
গত কয়েকমাসে বাংলাদেশে নতুন করে এক লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে৷ তাদের নিয়ে এখন বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ালো ১৩ লাখ ১৩ হাজার৷
গত ১৩ থেকে ১৬ মার্চ বাংলাদেশ সফর করেন জাতিসংঘ মহাসচিব অন্তোনিও গুতেরেস৷ তখন তিনি মানবিক করিডোরের প্রস্তাব দেন৷ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে৷ আর মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী রাখাইন দখলে থাকা আরাকান আর্মিকে জব্দ করতে সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে৷ ফলে সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ৷ এ কারণে বাংলাদেশ হয়ে রাখাইনে বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠাতে চায় জাতিসংঘ৷ জাতিসংঘ বলছে, রাখাইনে মানবিক সহায়তা না পাঠানো হলে সেখানে থাকা বাকি জনগোষ্ঠীর খাদ্য অনুসন্ধানে প্রতিবেশী দেশে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা আছে৷ আর এবার শুধু রোহিঙ্গারাই নয়, রাখাইনের বাকি জনগোষ্ঠীরও প্রবেশের শঙ্কা রয়েছে৷
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, করিডোরটিকে মানবিক ক্ষেত্রে ত্রাণ পাঠানোর জন্য চিহ্নিত করা হলেও এটি বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ৷ যেখানে আরাকান আর্মিকে কোণঠাসা করতে সব সরবরাহ আটকে দিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার, সেখানে বাংলাদেশ হয়ে যে ত্রাণ যাবে, তা রাখাইনের বেসামরিক নাগরিকদের কাছে পৌঁছাবে, নাকি আরাকান আর্মি সেগুলো দখলে নেবে- তার নিশ্চয়তা বাংলাদেশ পাবে?
রোহিঙ্গা এবং অভিবাসন বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনির বলেন, ” আরাকান আর্মি একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী৷ তাদের বিরুদ্ধে আছে মিয়ানমার সামরিক জান্তা৷ এখন প্রশ্ন হলো, সমঝোতা কীভাবে হবে? করিডোরের অনুমতি কারা দেবে, সামরিক জান্তা, না আরাকান আর্মি? ফলে একটি ঝুঁকি রয়েছে৷”
“এখন দেখার বিষয় জাতিসংঘ এটাকে কীভাবে ডিল করে, তারা কোন কোন পক্ষের সাথে কথা বলে৷ কিন্তু সেই সমঝোতায় বাংলাদেশকে অবশ্যই রাখতে হবে৷ এখানে নিরাপত্তার একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে৷ রাখাইনের প্রায় সব এলাকাই এখন আরাকান আর্মির দখলে৷ তারা তো আবার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে৷ অন্যদিকে মিয়ানমার জান্তা, তারাও আক্রমণ করছে৷ সব মিলিয়ে তো একটা নিরাপদ এলাকা লাগবে মানবিক করিডোর ও মানবিক সহায়তা বিতরণের জন্য৷ সেটা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হলেও সহায়তা তো আগে বাংলাদেশে ল্যান্ড করবে, তারপর রাখাইনে যাবে৷”
অন্যদিকে রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, ” একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত, রাষ্ট্র যেখানে যুদ্ধের কোনো বিরতি নাই, সেখানে হিউম্যানিটারিয়ান করিডোর করতে গেলে পাঁচটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে৷ অংশীজনদের অংশগ্রহণ থাকতে হবে৷ মালিকানা থাকতে হবে৷ তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ স্বচ্ছতা থাকতে হবে৷ আর মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন একটা ব্যবস্থাপনা লাগবে৷”
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক বলেন, “এখন কিন্তু রাখাইনে জাতিসংঘের কোনো ব্যবস্থাপনা বা তাদের উপস্থিতি নাই৷ তাদের কোনো লজিজিস্টিক সাপোর্ট নাই৷ সেখানে অনেক স্টাফ লাগবে, নিরাপত্তা লাগবে৷ এখন জাতিসংঘকে সেই কাজ শুরু করতে তো দুই পক্ষের সম্মতি লাগবে৷”
“শুধু আরাকান আর্মির সঙ্গে সমঝোতা করে এটা করা যায়৷ সেটা করলে মিয়ানমার সামরিক জান্তা যদি তখন আকাশপথে হামলা চালায়? তাদের এয়ারফোর্স খুবই শক্তিশালী৷ তখন তো বড় ধরনের নিরাপত্তা সংকট তৈরি হবে,” বলেন তিনি৷
তার কথা, ” মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির একমত হতে হবে৷ তা না হলে মানবিক করিডোর অবশ্যই বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকির হবে৷ প্রথমে তো আমি চ্যানেলের কথা শুনেছিলাম৷ বাংলাদেশ সরকারও কিন্তু আগে করিডোরের জন্য রাজি হয়নি৷ এখন তো করিডোরের কথা শুনছি৷”
ডিডাব্লিউ ডট কম
Leave a Reply