আর্কাদি গাইদার
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আর দেখি ডিরেক্টর-সায়েব লিজেই গাড়ি থেকে নেমে সেলাম ঠুকি আমারে কচ্চে: ‘শোন, বারুদ-ফাটাইওয়ালা মালিগিন, তুমি আমার মেয়েরে তোমার ইস্তিরি করি লাও। তাইলে তোমারে যৌতুক দেব দশ হাজার রুকূল আর এই ফোম্যানেরে মানে, ঘোড়াসুদ্ধ এই টমটম গাড়িটারে।’ শুনে তো আমি একদম থ’বনে গেলাম, ইটা সায়েব কয় কী! তা আহহ্লাদে ফুটিফাটা হয়ে যেই গাড়িতি চড়তে যাব অমনি ডিরেক্টর তার হাতের ছড়িগাছাটা দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটতে নাগল আমারে। আর সেই ফোরম্যান-ব্যাটা আমারে পায়ের নিচে ফেলি খুর দিয়ে ডলতি নাগল আর ডাক ছাড়তে নাগল, ‘হা-হাহা! হা-হা-হা! দ্যাখো ব্যাটার হাল দ্যাখো!’ তা ব্যাটা পায়ের নিচি ফেলে পিষতে নাগল তো নাগলই। শেষে এত কষ্ট হতি নাগল আমার যে ঘুমের মধ্যি ওঠলাম চৌচিয়ে। সারা মাটকোঠায় যত নোক ঘুমুচ্ছিল, সবার ঘুম ভেঙে গেল। একজনা তো আমার পাঁজরায় খোঁচা দিয়ে গালাগালই দিয়ে ওঠল কাউরে ঘুমুতে দিচ্চি না বলে।’
‘মাইরি, স্বপন বটে একখান!’ ফেদিয়া সির্ত্সভ হেসে উঠে বলল, ‘তোমার, দাদা, ছাড়িটারে বড্ড মনে ধরে গেছিল, তাই ওরে লিয়ে স্বপন দেখলে অমন, আমি বাজি ধরে কচ্চি। আমার তো সব্বদাই অমন হয় ঘুমুতে যাবার আগে কোনো কিছু লিয়ে ভাবলি সেই জিনিসের স্বপন দেখবই দেখব। সেদিন ওই-যে জার্মান
মড়াটার পা থেকে জুতোজোড়া খুলে লিতে ভুলে গেলাম। ভারি সোন্দর বুটজোড়া ছেল কিন্তু। তা এখন পেত্যেক রাত্তিরে ওই জুতোর স্বপন দেখতে নেগেচি!!
তিড়বিড়িয়ে উঠলেন মালিগিন। বললেন, ‘বুটজোড়া! বুটজোড়া! তুই নিজেই বুটজুতো কোথাকার! আমি বলে নোকটার মেয়েটারে তার আগে সারা বছরে মাত্তর একবারই দেখিচি। একদিন কষে মদ খেয়ে খানায় পড়ে ছিলাম। এমন সময় মেয়েটা আর তার মা বাড়ির সব্জি-বাগানের রাস্তা ধরে বেড়াচ্ছিল, ওদের গাড়ির ঘোড়াগুলা যাচ্ছিল পাশে-পাশে। মা তো মান্যিগণ্যি ভদ্দরঘরের মেয়েছেলে যেমন হয় তেমনি, পাকা চুল আমার কাছ-বরাবর এসে কইল: ‘তোমার নজ্জা নাগে না? মানুষ হিসেবে ময্যেদা বোধ কোথা গেল তোমার? ভগমানের কথা ভাব একবার।’ তা, আমি কলাম, ‘কী করব মা, ও মানুষের ময্যেদা-টয্যেদা আমার নেই, তাই মদ গিলি।’
‘তা মেয়েটার মা-র আমার ওপর কেমন দয়া হল। সে আমার হাতে এট্রা দশ কোপেক গুঁজে দিয়ে ক’ল: ‘ওরে চাষী, একবার চারদিক তাকিয়ে দ্যাখ। প্রিকিতি কেমন আহহ্লাদে আটখানা হয়েচে। সুয্যি আলো ছড়াচ্ছে, পাখিরা গান গাইচে আর তুই কিনা গিয়ে মদ গিলুচিস। যা, একটু সোডা-ওয়াটার কিনে খেগে যা, নেশা কমবে।’ শুনি খেপে গেলাম আমি। কলাম, ‘আমি চাষী না, আমি তোমাদের খনির মজুর। প্রিকিতি শালা খুশিতে ডগমগ হতে চায় তো হোক-না কেন, তা দেখি আমার আহমাদ হতে যাবে কিসের জন্যি শুনি? আর তোমার ওই সোডা-ওয়াটার, ও আমি জন্মে খাই নি।
তবে যদি দয়া করতেই চাও মা, তো আরও দশ কোপেক দিয়ে যাও আমারে। তাইলে আধ-বোতল ভোক্কা কিনে গলা ভেজাই আর মনে করি ভাগ্যে আজ তোমার সঙ্গে দেখা হল।’ শুনে বড়মানুষের বৌ আমারে কয় কিনা, ‘চাষা, একদম চাষা! কালই আমি আমার সোয়ামিরে কব তোরে এখেন থেকে, এই খনি থেকে বরখাস্ত করতে।’ এই বলে মেয়েছেলেটা তার মেয়েরে লিয়ে গাড়ি চেপে চলে গেল। ওই একবারই তার সঙ্গে আমার কথা হইছিল। আর মেয়েটা? সে তো আমাদের কথাবাত্তার সময় সারাক্ষণই মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর তুই কস কিনা আমি মেয়েটার দিকে বড্ড তাকিয়েচি, ওরে বড্ড মনে ধরেচে আমার?’