সারাক্ষণ রিপোর্ট
প্রযুক্তির রূপান্তর: ইউটিউবের কোরিয়ান সংস্করণ চালু ও বিস্তার
২০০৮ সালের ২৩ জানুয়ারি কোরিয়ান ভাষায় ইউটিউব চালু হওয়ার পর থেকেই দক্ষিণ কোরিয়া এক নতুন ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে। ইউটিউব চালু হবার ১৭ বছর পর, ২০২৫ সালে, দেশটি বিশ্বে ইউটিউব-নির্ভর সমাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে গড়ে উঠেছে। শুধু বিনোদনের জন্য নয়, রাজনীতি, সংবাদ, মতাদর্শ ও সংস্কৃতি রপ্তানিতেও ইউটিউব আজ একটি প্রধান মাধ্যম।
২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ওটিটি (অনলাইন স্ট্রিমিং) ব্যবহারকারীদের মধ্যে ইউটিউব ব্যবহার করেন ৮৪.৯ শতাংশ — যেখানে নেটফ্লিক্স ব্যবহারকারী মাত্র ৪৪.৪ শতাংশ। এটি কোরিয়ার মিডিয়া ব্যবহারে এক বিশাল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
নতুন টেলিভিশন: ইউটিউবই এখন ‘স্ক্রিন’
২০২৩ সালের অক্টোবরে কোরিয়ানরা ইউটিউবে সময় কাটিয়েছেন ১.০৪ বিলিয়ন ঘণ্টা — যা কাকাওটকের তুলনায় তিনগুণ এবং নেভারের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক গড় ইউটিউব ব্যবহারের সময় দাঁড়ায় ১৩৯ মিনিট — একজন কোরিয়ানের জেগে থাকার সময়ের প্রায় ১০ শতাংশ।
অন্যদিকে, নেভার এবং কাকাওটকের মতো দেশীয় অ্যাপে গড় ব্যবহার মাত্র ৩০ ও ২৫ মিনিট।
সংবাদ ও রাজনীতি: ইউটিউবের প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্ট
একটি আন্তর্জাতিক জরিপ অনুসারে, কোরিয়ার ৭৫ শতাংশ নাগরিক ইউটিউবকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন — যা বিশ্বব্যাপী গড় ৬১ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি।
বিশেষত, সংবাদ গ্রহণের ক্ষেত্রে ইউটিউব এখন প্রধান মাধ্যম। কোরিয়া প্রেস ফাউন্ডেশন ও অক্সফোর্ডের রয়টার্স ইনস্টিটিউটের যৌথ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কোরিয়ার ৫১ শতাংশ মানুষ ইউটিউব থেকে সংবাদ পান — যা ৪৭টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং বৈশ্বিক গড় ৩১ শতাংশের অনেক উপরে।
২০১৭ সালে ইউটিউবের সংবাদ-ব্যবহার ছিল ২৬ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে বেড়ে ৫১ শতাংশ হয়েছে। ফেসবুকের প্রভাব এক্ষেত্রে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯ শতাংশে। ইউটিউবের অ্যালগরিদম ব্যবহারকারীদের মাঝে মতাদর্শিক বিভাজনকে আরও তীব্র করছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
সংকটকালে ইউটিউব: সরাসরি সম্প্রচারে রাজপথের রণক্ষেত্র
২০২৪ সালের শেষ দিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় এক সাংবিধানিক সংকট দেখা দেয়, যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়লকে সামরিক আইন অবৈধভাবে জারির অভিযোগে অভিশংসিত করা হয়। বিক্ষোভের সময় ইউটিউব হয়ে ওঠে তথ্য, প্রচার ও রাজনৈতিক মতাদর্শ ছড়ানোর প্রধান প্ল্যাটফর্ম।
জানুয়ারি ১৯ তারিখে সিউল ওয়েস্টার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে সহিংস বিক্ষোভের সময় ইউটিউবাররা সরাসরি সম্প্রচার করছিলেন আদালত ঘিরে সংঘর্ষের দৃশ্য। ইউন নিজেও বলেন, তিনি ইউটিউবেই লাইভে তার সমর্থকদের কার্যক্রম দেখেছেন।
সংস্কৃতি রপ্তানির হাতিয়ার: গ্যাংনাম স্টাইল থেকে বিটিএস ও ব্ল্যাকপিংক
২০১২ সালে সাই-এর ‘গ্যাংনাম স্টাইল’ প্রথম ইউটিউব ভিডিও হিসেবে ১ বিলিয়ন ভিউ অতিক্রম করে। বর্তমানে এটির ভিউ ৫.৫ বিলিয়নেরও বেশি। সাই নিজে বলেন, “গ্যাংনাম স্টাইল প্রমাণ করেছিল, কোরিয়ান সঙ্গীত ইউটিউবের মাধ্যমে রাতারাতি বিশ্বজয় করতে পারে।”
বিটিএস ও ব্ল্যাকপিংকের মতো ব্যান্ডগুলো ইউটিউবকে বিশ্বব্যাপী নিজেদের বিপণনের প্রধান মাধ্যম বানিয়েছে। বিটিএস ২০২০ সালে ‘ডায়নামাইট’ গানের মাধ্যমে বিলবোর্ড হট ১০০-তে প্রথম স্থান দখল করে ইতিহাস গড়ে।
ব্ল্যাকপিংক বর্তমানে ইউটিউবে সর্বাধিক সাবস্ক্রাইব করা শিল্পী (৯৬.৪ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার ও ৩৮.৩ বিলিয়ন ভিউ)। তারা ইউটিউবের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চার্টেও শীর্ষস্থান অর্জন করেছে।
YG ও স্টারশিপ এন্টারটেইনমেন্টের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ইউটিউবেই প্রিমিয়ার করছে নতুন ব্যান্ডের আত্মপ্রকাশ বা সার্ভাইভাল শো।
অতিরিক্ত প্রভাবের বিপরীতে তদন্ত ও নিয়ন্ত্রণ
২০২৪ সালে কোরিয়ার প্রতিযোগিতা কমিশন ইউটিউব মিউজিক ও প্রিমিয়ামের প্যাকেজ নিয়ে গুগলের বিরুদ্ধে একটি অ্যান্টিট্রাস্ট তদন্ত শুরু করে। এর মাধ্যমে গুগল একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ ওঠে।
এই প্রবণতা আন্তর্জাতিকভাবে আরও দৃশ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের এক আদালত সম্প্রতি গুগলের বিরুদ্ধে অনলাইন বিজ্ঞাপন বাজারে একচেটিয়াতা প্রতিষ্ঠার রায় দেয়। ভবিষ্যতে ইউটিউবকে গুগল থেকে বিচ্ছিন্ন করার চাপও বাড়তে পারে।
যেখানে সব প্রজন্ম ইউটিউবমুখী
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো—৫০-৬০ বছর বয়সী কোরিয়ানরাও এখন ইউটিউব থেকে সংবাদ গ্রহণে সবচেয়ে সক্রিয় (৫২-৫৫ শতাংশ)। বৈশ্বিক গড় যেখানে মাত্র ২৮-৩২ শতাংশ।
তাছাড়া অর্থনৈতিক বিবেচনায়ও ইউটিউব সুবিধাজনক। ২০২৪ সালে কোরিয়ানরা প্রতি মাসে পেইড ওটিটি পরিষেবায় গড়ে খরচ করেছে মাত্র ১০,৫০০ ওন ($৭), যা পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে কিছুটা কম।
উপসংহার: ইউটিউব এখন কোরিয়ার ডিজিটাল জনচত্বর
কোরিয়া প্রেস ফাউন্ডেশনের এক গবেষক বলেন, “ইউটিউব কোরিয়ার সমাজে এমনভাবে মিশে গেছে—যেখানে সংবাদ, বিনোদন, এমনকি রাজনৈতিক সংগঠনের ক্ষেত্রেও এটি অপরিহার্য। এটি এখন আর শুধুমাত্র একটি প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং একটি ডিজিটাল জনচত্বর।”