নাসির জামাল
যদিও ইন্দাস পানি চুক্তি (আইডব্লিউটি) একতরফাভাবে বাতিল বা স্থগিত করার কোনো ধারা নেই, তবু কাশ্মীরের পর্যটনকেন্দ্র পাহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ৬৪ বছর পুরোনো এই পানি‐বণ্টন চুক্তি ‘মুলতবি’ ঘোষণা করে ভারত পাকিস্তানের জীবনরেখা প্রবাহ বন্ধে অতিরিক্ত পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত—এ কথাই স্পষ্ট হয়েছে।
এ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে নয়াদিল্লি নিজ দেশের বিশেষজ্ঞদের সেই সতর্কবার্তাও উপেক্ষা করেছে, যেখানে বলা হয়েছিল—এ ধরনের একতরফা পদক্ষেপ ইন্দাস নদী অববাহিকার বিস্তৃত অঞ্চলে (ভারত, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তান) পানি সহযোগিতায় ঢেউ তুলবে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় ঝুঁকি তৈরি করবে এবং ভারতের ‘দায়িত্বশীল রাষ্ট্র’ ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা, অথবা পাকিস্তানকে শর্ত পরিবর্তনে বাধ্য করার এটিই ভারতের প্রথম প্রয়াস নয়। ২০১৬ সালে উরি হামলার পর থেকেই ভারত ধারাবাহিকভাবে আইডব্লিউটি দুর্বল করার চেষ্টা করে আসছে।
গত তিন বছর ধরে চুক্তির অগ্রগতি কার্যত থমকে আছে; এমনকি স্থায়ী ইন্দাস কমিশনের নিয়মিত বৈঠকও স্থগিত। বন্যা ও অন্যান্য কারিগরি তথ্যের আদান‐প্রদানও সীমিত হয়ে গেছে।
যে আইনি প্রতিকারই থাকুক, পাকিস্তানের পানি‐অধিকার রক্ষার লড়াই দীর্ঘ ও জটিল হবে, এটিই স্বাভাবিক।
চুক্তি অনুসারে, দুই দেশের কমিশনারদের প্রতি বছর অন্তত একবার, পালাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানে বসা বাধ্যতামূলক। এই বৈঠক স্থগিতের ধারাবাহিকতায় ভারত ২০২৩‑এর জানুয়ারি ও ২০২৪‑এর সেপ্টেম্বর—দুই দফা নোটিশ পাঠিয়ে ‘গুরুতর ও অপ্রত্যাশিত’ পরিবর্তনের (জনসংখ্যা, জলবায়ু, বাস্তবায়নগত চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি) অজুহাতে শর্ত পুন:আলোচনার আহ্বান জানায়।
কিন্তু ১৯৬৯ সালের ভিয়েনা কনভেনশন অন দি ল‐ অব ট্রিটিজ‐এ স্পষ্ট, ‘পরিস্থির বদল’ চুক্তি বাতিল বা স্থগিতের বৈধ কারণ নয়। ভারত একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল করলে অন্য আন্তসীমান্ত পানি চুক্তিগুলোও ঝুঁকির মুখে পড়বে; একবার দৃষ্টান্ত তৈরি হলে অনুকরণ সহজ হয়।
রাট্লে প্রকল্প ও কিশেনগঙ্গা বাঁধের নকশা নিয়ে বিরোধের জেরে কমিশন বৈঠক স্থগিত এবং পুনর্মূল্যায়নের নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
চুক্তি ঊর্ধ্বপ্রবাহি দেশকে (ভারতকে) পশ্চিম দিকের তিন নদী—ইন্দাস, ঝেলম ও চেনাবে ‘রান‐অব‐দ্য‐রিভার’ প্রকল্পের অনুমতি দেয়, তবে বড় জলাধার বানিয়ে পানি জমা বা সরিয়ে নেওয়া নিষিদ্ধ। জলাধারের আকার ও নকশা নিয়ে দুই দেশের বিরোধ তৈরি হয়েছে; পাকিস্তানের আশঙ্কা, নকশা বদলে পানি সংরক্ষণ করা হচ্ছে, যা চুক্তিভঙ্গ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চুক্তি স্থগিত থাকলে ভারত বিদ্যমান অবকাঠামো বদলে কিংবা নতুন প্রকল্প গড়ে বেশি পানি ধরে রাখতে বা ভিন্ন দিকে সরিয়ে দিতে পারবে, এবং পাকিস্তানকে আর তথ্য দিতেও হবে না। তাছাড়া, মৌসুমি পানি ছাড়ার সূচি পাল্টে দেবে।
ইসলামাবাদভিত্তিক জিন্নাহ ইনস্টিটিউটের এক নোটে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লি বন্যার মৌসুমে নয়, বরং শুষ্ক মৌসুম—অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি—এ জলাধার খালি ও পূরণ করবে, যা পাকিস্তানের বপন সময় ব্যাহত করবে। দীর্ঘমেয়াদে ইন্দাস ব্যবস্থায় একের পর এক বাঁধ নির্মাণ ও আপগ্রেডের পরিকল্পনা নিয়ে আশঙ্কা বাড়ছে—পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি ও আঞ্চলিক অস্থিরতা উভয়ই ত্বরান্বিত হতে পারে।
নোটে আরও বলা হয়েছে, ব্যাপক প্রকৌশল ও পরিবেশগত সমন্বয় ছাড়া ভারতের পক্ষে পাকিস্তানের পানি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়; তাতে বিপুল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক খরচ রয়েছে। খাল বা সুড়ঙ্গ কেটে পানি অন্য দিকে নেওয়া ভৌগোলিকভাবেও ঝুঁকিপূর্ণ; এতে ভারতেরই উজানে বন্যা এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের আশঙ্কা থাকে।
তবু মৌসুমি পানি ছাড়ায় কারসাজি বা বন্যা তথ্য গোপনের মাধ্যমে পাকিস্তানের ফসলচক্র ও ফলন ব্যাহত করা, খরচ বাড়ানো—এসব সহজেই সম্ভব। সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ঝুঁকি হল অনিশ্চয়তা সৃষ্টি: কয়েক দশক ধরে যে পূর্বানুমেয়তা কৃষি ও জ্বালানি খাতে ভরসা জুগিয়েছে, তা ভেঙে পড়তে পারে।
এ ছাড়া পানি অস্ত্রায়ণের নজির অন্য ঊর্ধ্বপ্রবাহি দেশগুলোকে প্রতিশোধমূলক ধাঁচে উৎসাহিত করতে পারে। নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ ভারতের আচরণ পর্যবেক্ষণ করছে; পাকিস্তানের অধিকার অগ্রাহ্য করলে নয়াদিল্লি ‘পানি’কে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানাতে প্রস্তুত—এই ধারণা পোক্ত হবে। এতে কোশি, তিস্তা ও গঙ্গা অববাহিকা নিয়ে চলমান ও ভবিষ্যৎ আলোচনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এই শতাব্দীতে প্রথমবার কোনো দেশ প্রকাশ্যে পানি অস্ত্রায়ণ করলে তা বৈশ্বিক কলঙ্ক ডেকে আনবে, ভারতের আঞ্চলিক নেতৃত্বের দাবিকে দুর্বল করবে, আন্তর্জাতিক সমালোচনার দরজা খুলবে এবং এমন তুলনা হাজির করবে, যেগুলোর জবাব দেওয়া কঠিন হবে।
পাকিস্তানের ভাষ্য, আইডব্লিউটি অনুযায়ী তার পানিপ্রবাহ থামানো বা সরিয়ে নেওয়া, অর্থাৎ নিম্নপ্রবাহি হিসেবেও তার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া ‘যুদ্ধ ঘোষণার’ সামিল। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ পূর্ণ শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রয়টার্সকে দেওয়া বক্তব্যে আইন ও বিচারবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার আকিল মালিক জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকে (যারা চুক্তির তত্ত্বাবধায়ক) অভিযোগ তোলা সহ অন্তত তিনটি আইনি পথ নিয়ে কাজ করছে সরকার।
তিনি বলেন, স্থায়ী সালিশি আদালত বা আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতেও (আইসিজে) পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে—যেখানে ভারত ১৯৬৯ সালের ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে, এই যুক্তি তুলে ধরা হবে। ‘আইনি কৌশল প্রায় শেষপর্যায়ে,’ জানান মালিক; কোন কোন মামলা করা হবে, সে সিদ্ধান্ত ‘শিগগিরই’ নেওয়া হবে এবং সম্ভবত একাধিক পথেই এগোনো হবে।
তিনি আরও জানান, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উত্থাপনের একটি কূটনৈতিক বিকল্পও বিবেচনায় আছে। সবমিলিয়ে, চুক্তি ও প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে যে আইনি প্রতিকারই হাতের নাগালে থাকুক, আইডব্লিউটি রক্ষা ও পানি‐অধিকার বজায় রাখার লড়াই পাকিস্তানের জন্য দীর্ঘ, জটিল এবং প্রধানত কূটনৈতিক বলয়ে চলমানই থাকবে।
(ডন, বিজনেস অ্যান্ড ফাইন্যান্স উইকলি, ৫ মে ২০২৫ এ প্রকাশিত নিবদ্ধটির বাংলা অনুবাদ)