সারাক্ষণ রিপোর্ট
জন্মহার ও করপোরেট সংকটে জাপান
জাপানে জন্মহার এখন মাত্র ১.২ — একটি জাতির ভবিষ্যতের জন্য তা একটি বিপজ্জনক সংকেত। কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা এখন আর কেবল আলোচনা নয়, বরং জাতীয় অস্তিত্বের সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য চারদিনের কর্মসপ্তাহ চালুর প্রস্তাব এসেছে, তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আসল পরিবর্তন দরকার সমাজ কাঠামোতেই।
কর্মঘণ্টা কমানোর সম্ভাব্য সুবিধা
বিশ্বজুড়ে গবেষণা বলছে, কম কর্মঘণ্টা মানে ভালো ঘুম, পরিবারকে সময় দেওয়া, মানসিক প্রশান্তি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি — যা সন্তান জন্ম দেওয়ার পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক। তবে জাপানের স্থবির অর্থনীতিতে কর্মঘণ্টা কমানো মানে হতে পারে কম বেতন — যা কর্মীদের অর্থনৈতিকভাবে আরও দুর্বল করে তুলবে।
সমাজ কাঠামোর মূল তিন স্তম্ভ
সমস্যা শুধু কর্মঘণ্টা নয়, বরং জাপানি সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা তিনটি স্তম্ভ: ‘সালারিমান’, ‘গৃহিণী’ এবং কোম্পানির শাসকসুলভ কর্তৃত্ব। প্রযুক্তিনির্ভর নতুন কোম্পানিগুলো কিছুটা নমনীয় হলেও পুরনো উৎপাদন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও সেই পুরনো মডেলে চলছে।
পুরনো পরিবারের মডেল ও তার ভাঙন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা দুনিয়ায় তিন ধরনের সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা তৈরি হয়:
- যুক্তরাষ্ট্রের ‘লিবারেল মডেল’ — যেখানে পুরুষ-নারী দুজনকেই সমানভাবে পরিশ্রম করতে হয়।
- নর্ডিক দেশের ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক মডেল’ — যেখানে রাষ্ট্র পুরো দায়িত্ব নেয় এবং নারী কর্মীদের বিশাল অংশ রাষ্ট্রীয় সেবায় যুক্ত।
- দক্ষিণ ইউরোপের ‘কনজারভেটিভ মডেল’ — যেখানে পুরুষ উপার্জন করে এবং নারী ঘরে থাকে।
জাপান এদের কোনোটি নয়। তারা গড়েছে ‘জাপানি স্টাইল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’, যেখানে পুরুষ কোম্পানির প্রতি আজীবন আনুগত্য দেখাবে আর নারী বিনামূল্যে ঘরের কাজ করবে।
‘সালারিমান’ মডেলের বাস্তবতা ও ফলাফল
এই মডেলের মধ্যে ছিল:
- ২৫ বছর বয়সে বিয়ে
- ৩০-এর মধ্যে দুই সন্তান
- ৩৫-এর মধ্যে নারী হয় ‘টাইগার মম’ নয়তো খণ্ডকালীন শ্রমিক
এরকম নারীদের ‘ক্রিসমাস কেক’ বলে উপহাস করা হতো — ২৫ ডিসেম্বর পার হলে অবিক্রিত কেকের মতো মূল্যহীন।
এই কাঠামো কোম্পানির জন্য কার্যকর হলেও, পুরুষের ঘুমহীনতা ও অতিরিক্ত কাজের চাপ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে — যাকে বলা হয় ‘কারোশি’। নারীরা পার্ট-টাইম কাজ করলেও তারা ক্যারিয়ারে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পাননি।
দ্বৈত কর্মসংস্থান ব্যবস্থা ও নারীদের বৈষম্য
জাপানে দুই ধরনের চাকরির ধারা আছে:
- সাধারণ ট্র্যাক (ippan shoku): যেখানে নারী থাকেন, অগ্রগতি কম।
- ক্যারিয়ার ট্র্যাক (sogo shoku): যেখানে পুরুষ থাকেন, বেতন ও পদোন্নতি বেশি।
এতে নারীরা পিছিয়ে পড়েন, আর পুরুষরা ‘কোম্পানির সম্পদ’ হয়ে যান।
তিন স্তম্ভের পতন ও নতুন প্রজন্মের অনীহা
১৯৯০-এর দশকে বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে কোম্পানিগুলোর অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ভেঙে পড়ে। ফলে তরুণ প্রজন্ম প্রশ্ন তোলে — কেন বিয়ে করবো? কেন সন্তান নেবো? কেন এই অন্যায্য ব্যবস্থায় অংশ নেবো?
এখন নারীরা বিপুল হারে কর্মজীবনে যুক্ত হচ্ছেন — একদিকে জনসংখ্যার ঘাটতি, অন্যদিকে অর্থনৈতিক চাপ। কিন্তু পুরনো কাঠামো ভাঙেনি।
সমাধান কী?
চারদিনের কর্মসপ্তাহ তখনই কার্যকর হবে, যদি পুরনো করপোরেট-নির্ভর সামাজিক কাঠামো ভেঙে ফেলা যায়। ‘সালারিমান’ শব্দটিও এখন অবসরে যাওয়ার সময় হয়েছে।
ইতিবাচক পরিবর্তনের কিছু উদাহরণ
- মেরকারি, সাইবারএজেন্টসহ কিছু জাপানি কোম্পানি এখন ফ্লেক্সিবল সময়, রিমোট ওয়ার্ক ও ফলাফল-ভিত্তিক মূল্যায়ন চালু করেছে।
- জাপানে কর্মরত বিদেশি কোম্পানিগুলোও ভালো পরিবেশের উদাহরণ দিচ্ছে।
প্রযুক্তি ও উৎপাদনশীলতা
প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় কাজ কমিয়ে দিয়ে ব্যক্তিগত সময় বাড়ানো সম্ভব। ঘন্টার সংখ্যা কমানোর চেয়ে কাজের ধরন পরিবর্তনই বেশি জরুরি।
ভবিষ্যতের করণীয়
- জেন্ডার-বৈষম্যহীন নিয়োগ প্রক্রিয়া
- জোরপূর্বক বদলি বন্ধ
- আউটপুটভিত্তিক বেতন পদ্ধতি
- স্থিতিশীল বেসিক বেতন নিশ্চিত করা
রিক্কিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাসাতাকা হোন্ডার ‘দ্য বার্থ অব ফ্যামিলি’ বইয়ে বলা হয়েছে — সমাজে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে বলেই পরিবার গড়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রীয় নীতিরও সংস্কার দরকার
বর্তমান কল্যাণনীতি এখনো পুরনো পুরুষ-কেন্দ্রিক মডেলের উপর নির্ভরশীল। স্বামী নির্ভর কর ট্যাক্স ছাড়সহ নীতিগুলোকে বাতিল করতে হবে।
উপসংহার
পুরুষ, নারী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান — সবাইকে একে অপরের উপর নির্ভরতা থেকে মুক্ত হতে হবে। সুস্থ সম্পর্ক তখনই সম্ভব, যখন সবাই স্বাধীনভাবে দাঁড়াতে পারে। পুরনো এই করপোরেট-বিয়ের ছক এখন আর কাজ করছে না — আর জাপানের করপোরেশনগুলোও এর সুফল পাচ্ছে না বছরের পর বছর ধরে।