সারাক্ষণ রিপোর্ট
বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য এবং প্রায় ৪৫ লাখ মানুষের জীবন–জীবিকার ভিত্তি। সাম্প্রতিক দশকে ঘনীভূত জলবায়ু পরিবর্তন পর্বত্ ঢাল, বনভূমি ও মানবজনিত ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার সঙ্গে মিলে বনের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সামগ্রিক প্রভাব
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সালের মধ্যে গড়ে ৫০ সেন্টিমিটার বাড়তে পারে—ফলে বাংলাদেশের মোট ভূমির ১১ শতাংশ হারানোর ঝুঁকি রয়েছে, যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করতে পারে। একই সঙ্গে ভূমি ধস ও পলি জমার স্বাভাবিক চক্রে ব্যাঘাত ঘটছে, যা সুন্দরবনের নিচু দ্বীপগুলোকে আরও দুর্বল করে তুলছে। ঘূর্ণিঝড় আইলা (২০০৯): এক যুগ পরও স্থায়ী আঘাত ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘণ্টায় প্রায় ১২০ কিমি বেগে আছড়ে পড়া আইলা সুন্দরবনের বাংলাদেশের অংশে ১ ৯০ জনের বেশি প্রাণহানি ঘটায় এবং অসংখ্য কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে লবণাক্ত জল ঢুকে পড়ে। কয়েক হাজার একর কৃষিজমি দীর্ঘমেয়াদে অনুর্বর হয়ে পড়ায় মানুষের বিকল্প জীবিকা হিসেবে বনের উপর নির্ভরতা বেড়ে যায়—ফলে কাঠ, মধু ও মাছের অতিরিক্ত আহরণ বনের বিপন্নতাই বাড়ায়।
ঘূর্ণিঝড় আমফান (২০২০): অতলস্পর্শী বিপর্যয়
২০২০ সালের ২০ মে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় আমফান (সর্বোচ্চ বাতাসের বেগ ২৪০ কিমি/ঘণ্টা) পশ্চিমবঙ্গ–সুন্দরবন উপদ্বীপ অতিক্রম করে। বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলে ৭৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রায় ১০ লাখ বাড়ি বিধ্বস্ত হয় এবং হাজার কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়; সুন্দরবনের ১২ শতাংশেরও বেশি ম্যানগ্রোভ বৃক্ষপাতা ঝরে যায়, বাঘ ও হরিণের আবাসস্থল নষ্ট হয়।
আইলা বনাম আমফান: পরিবর্তিত ঘূর্ণিঝড়ের রূপ
দুই দশকের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, যা ঘূর্ণিঝড়কে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করতে সহায়তা করেছে। আইলা অপেক্ষাকৃত দুর্বল হলেও বাঁধ ভেঙে দীর্ঘমেয়াদি লবণাক্ততা এনেছিল; আমফান আকারে ও গতিতে বড় হওয়ায় তীব্র ঝুঁকি সৃষ্টি করলেও উন্নত পূর্বাভাস ব্যবস্থা প্রাণহানি সীমিত রেখেছে।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের উপর অভিঘাত
বারবার ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ম্যানগ্রোভের প্রাকৃতিক রিজেনারেশন বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পাশাপাশি ডিফোলিয়েশন ও মৃত্তিকা ক্ষয়ের পরিমাণ বেড়েছে। কার্বন শোষণের ক্ষমতা হ্রাস পেলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ার দুষ্টচক্র তৈরি হয় এবং রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আবাস সংকুচিত হয়।
জনজীবন ও অর্থনৈতিক ধাক্কা
লবণাক্ততায় কৃষি ও পুকুর–মৎস্য হ্রাস পায়; খুলনা ও সাতক্ষীরার উপকূল থেকে বহু পরিবার জীবিকা বদল করে শহরে পাড়ি দিচ্ছে। নারী নেতৃত্বে ম্যানগ্রোভ নার্সারি ও রোপণ কর্মসূচি নতুন বিকল্প আয়ের পথ তৈরি করছে, যা একই সঙ্গে পরিবেশ পুনরুদ্ধারেও ভূমিকা রাখছে।
দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস
গবেষণা অনুমান করছে, বর্তমান প্রবণতা চলতে থাকলে ২০৭০ সালের মধ্যে পুরো সুন্দরবনই ডুবতে পারে; একই সময়ে জাতীয় পর্যায়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা কয়েক কোটি ছুঁতে পারে।
অভিযোজন ও প্রতিরোধের পথ
বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ অনুসারে টেকসই বাঁধ, নদীখাত পুনঃখনন এবং ক্রমাগত ম্যানগ্রোভ বনায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নারী–নেতৃত্বাধীন কমিউনিটি নার্সারি, ইকো–ট্যুরিজম ও বিকল্প জীবিকায় বিনিয়োগ স্থানীয় অর্থনীতিকে সহায়তা করছে এবং বন সংরক্ষণের সামাজিক ভিত্তি জোরদার করছে।
সুপারিশ
• ভারত–বাংলাদেশের যৌথ ম্যানগ্রোভ ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত তহবিল ও ডেটা বিনিময় প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে।
• বাঁধ নির্মাণে প্রকৌশল ও প্রকৃতি–নির্ভর সমাধানের সমন্বয় (hybrid embankment) নিশ্চিত করতে হবে।
• জলবায়ু অভিযোজন তহবিল থেকে সুন্দরবন–নির্ভর ক্ষুদ্র কৃষক ও জেলে পরিবারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
• মহিলাদের নেতৃত্বাধীন পুনরুদ্ধার কর্মসূচিতে কার্বন ক্রেডিট ও সামাজিক প্রভাব বিনিয়োগ সংযুক্ত করা দরকার।
আইলা ও আমফান–দুটি বিপর্যয়ই সুন্দরবনের সাংঘাতিক ঝুঁকির মাত্রা উন্মোচন করেছে। তবে একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে, বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাস, কমিউনিটি উদ্যোগ ও প্রকৃতি–নির্ভর সমাধান মিলিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি সহনশীল পথ রচনা করা সম্ভব। সুন্দরবন বাঁচানো মানে কেবল একটি অরণ্য নয়—বাংলাদেশের উপকূলে অথৈ সমুদ্রের সামনে শেষ প্রতিরোধটিকে টিকিয়ে রাখা।