পরিচিত কণ্ঠের অদৃশ্য আতঙ্ক
প্যারিসের রাস্তায় তাঁকে কেউ না চিনলেও—ফরাসি দর্শকদের মধ্যে বরিস রেহলিঙ্গারের কণ্ঠ অতি পরিচিত। বেন অ্যাফ্লেক, জোয়াকিন ফিনিক্স কিংবা ‘পুস ইন বুটস’-এর ফরাসি স্বর হিসেবে খ্যাত এই শিল্পী এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে নিজের পেশা টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করছেন। “আমার কণ্ঠ এখনো এআই দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়নি, তবু হুমকি অনুভব করি,” বললেন ‘Touche Pas Ma VF’ আন্দোলনের এই মুখপাত্র। তাঁর মতে, অভিনেতা, অনুবাদক, ডায়ালগ অ্যাডাপ্টার ও সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার—সবাই মিলে এমন নিখুঁত সমন্বয় গড়ে তোলেন, যাতে দর্শক বুঝতেই পারেন না পর্দার অভিনেতা অন্য ভাষায় কথা বলছেন।
স্ট্রিমিং যুগে ডাবিংয়ের বাড়তি চাহিদা
নেটফ্লিক্সের মতো বৈশ্বিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ‘স্কুইড গেম’ ও ‘লুপিন’-এর সাফল্যের পর ডাবিংয়ের চাহিদা আকাশ ছুঁয়েছে। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও যুক্তরাজ্যে ৪৩ শতাংশ দর্শক সাবটাইটেলের চেয়ে ডাবিং পছন্দ করেন—জিডাব্লিউআই নামের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য এমনই। ২০২৫ সালে বিশ্বব্যাপী ডাবিং বাজারের আয় ৪.৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০৩৩ সালে ৭.৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিজনেস রিসার্চ ইনসাইটস। বাড়তি আয়ের ক্ষেত্র খুঁজতে স্টুডিওগুলোর দৃষ্টি তাই সাশ্রয়ী এআই সমাধানের দিকে।
‘হাইওয়ে কোড’ চাই: শিল্পীদের আইনি সুরক্ষা দাবি
এআই যত উন্নত হচ্ছে, ততই কম খরচে ডাবিং করা যাচ্ছে—ফলে কর্মসংস্থান ও গুণগত মান নিয়ে শিল্পীদের উদ্বেগ বাড়ছে। ইউরোপজুড়ে ভয়েস অভিনয়‑শিল্পী সংগঠনগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে কপিরাইট, ন্যায্য পারিশ্রমিক ও স্পষ্ট লেবেলিংয়ের কঠোর আইন চাইছে। রেহলিঙ্গারের ভাষায়, “গাড়ি যেমন ঘোড়ার গাড়িকে বদলে দিয়েছিল, তেমনি এখন ‘হাইওয়ে কোড’-সদৃশ নিয়ম দরকার।”
হলিউডের অভিজ্ঞতা ও নতুন চুক্তি
এআই নিয়ে হলিউডেও উত্তেজনা নতুন নয়—২০২৩ সালের ধর্মঘট-পরবর্তী চুক্তিতে এর ব্যবহারবিধি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। নেটফ্লিক্স ইতিমধ্যেই ‘এল ইতারনাউতা’ সিরিজে জেনারেটিভ এআই দিয়ে ভিজ্যুয়াল এফেক্ট ব্যবহার করেছে এবং কিছু প্রকল্পে এআই‑সহায় লিপ‑সিঙ্ক পরীক্ষাও চালিয়েছে। তবে সেসব ক্ষেত্রেও স্থানীয় ভয়েস অভিনেতারাই কণ্ঠ দেন এবং চুক্তি অনুযায়ী পারিশ্রমিক পান।
জার্মানির প্রতিবাদ—‘শিল্পী বাঁচাও, কৃত্রিম নয়’
জার্মানিতে ১২ জন তারকা ভয়েস অভিনেতার একটি টিকটক ভিডিও মার্চে ৮.৭ মিলিয়ন ভিউ পায়; তাদের স্লোগান—“শিল্পী সুরক্ষিত হোক, কৃত্রিম নয়।” ভয়েস অভিনেতা সংগঠন ভিডিএস‑এর পিটিশনে সই করেছেন ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ। মূল দাবি—এআই কোম্পানিগুলোর প্রশিক্ষণ ডেটা তৈরিতে শিল্পীদের স্পষ্ট অনুমতি, ন্যায্য পারিশ্রমিক ও এআই‑সৃষ্ট কনটেন্টে স্বচ্ছ লেবেল।
স্টুডিওর পরীক্ষানিরীক্ষা: ফল মিশ্র
নতুন প্রযুক্তি একেবারে এড়িয়ে যাচ্ছেন না অনেক প্রযোজক। জার্মান স্টুডিও ‘নয়ে টোনফিল্ম মিউনিখ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবারহার্ড ভেকার্লে আশা করেন, মানব ও এআই—দুটি পদ্ধতিই সহাবস্থান করবে। তবে খরচ বাঁচাতে যদি নিম্নমানের এআই ডাবিং চালু হয়, সেটিই হবে “সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।” এরই মধ্যে পোলিশ সিরিজ ‘মার্ডারেসেস’-এর জার্মান এআই ডাব সংস্করণ একঘেয়ে আওয়াজের কারণে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম থেকে সরাতে হয়েছে।
‘বড়ই আগ্রহ’: এআই কোম্পানির দৃষ্টিভঙ্গি
অডিও ইনোভেশন ল্যাবের প্রধান নির্বাহী স্টেফান স্পর্ন মনে করেন, এআই ভয়েস শিল্পকে “পুনর্গঠন” করবে, তবে “প্রতিস্থাপন” নয়। আবেগ, স্ক্রিপ্ট ও ভাষার সূক্ষ্মতা আনতে মানুষই লাগবে—শুধু সংখ্যায় কম। তাঁদের প্রযুক্তি মূল অভিনেতার স্বরকে লক্ষ্য‑ভাষায় মানিয়ে নেয়, ফলে সময় ও খরচ বাঁচে। একই লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাজ্যের ফ্ল‑লেস এআই স্থানীয় শিল্পীদের কণ্ঠ ব্যবহার করে ঠোঁটের নড়াচড়ার সঙ্গে মিলিয়ে দেয়—তাদের মতে, সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এআই চলচ্চিত্র নির্মাণে “সিলভার বুলেট” হতে পারে।
ভবিষ্যৎ: সহাবস্থান না প্রতিস্থাপন?
দর্শকের একাংশ এআই ডাবিং শুনে ফারাক টের পান—আবার অনেকে পার্থক্যই বোঝেন না। জিডাব্লিউআই জরিপে দেখা গেছে, প্রিয় কনটেন্ট এআই‑নির্ভর শুনে ৪৮ শতাংশ দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায় না, ২৫ শতাংশ খানিকটা কম পছন্দ করেন এবং মাত্র ৩ শতাংশ বেশি পছন্দ করেন। প্রযুক্তি দ্রুত এগোচ্ছে; শিল্পীরা জোর দিচ্ছেন—আইনি কাঠামো ও নৈতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করেই কেবল নতুন পথ খুলতে হবে। নচেৎ অগণিত পরিচিত কণ্ঠ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে।