বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ অনলাইন সেন্সিটিভ এবং নির্ধারিত বয়সের জন্য উপযোগী বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণে কঠোর হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে এখন অনেক জায়গায় পরিচয়পত্র বা জাতীয় ডাটাবেইসের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের বয়স যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চুপিচুপি এক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে: ভিপিএন বা ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক ব্যবহারের হার হু হু করে বাড়ছে—বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মতো সংরক্ষণশীল সমাজে, যেখানে সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে প্রযুক্তিগত বিধিনিষেধ হাত ধরাধরি করে চলে।
নতুন এক অনলাইন বাস্তবতা: পরিচয় যাচাই এখন বাধ্যতামূলক
ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং অ্যাপে বয়স নির্ধারিত বিষয়বস্তুতে প্রবেশ করতে চাইলে কড়া পরিচয় যাচাই প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। কোথাও জাতীয় পরিচয়পত্র, কোথাও মুখের ছবি, আবার কোথাও ক্রেডিট কার্ড বা সরকারি ডাটাবেইস যাচাই ছাড়া প্রবেশের সুযোগ নেই।
এই ব্যবস্থাগুলোর উদ্দেশ্য হলো কিশোর-কিশোরীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ব্যক্তি-পরিচয়ের সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহারের যোগসূত্র স্থাপন হচ্ছে—যা পরবর্তীতে নজরদারি বা তথ্য অপব্যবহারের ঝুঁকি বাড়ায়।
ভিপিএনের চাহিদা যেভাবে বাড়ছে
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় ভিপিএন কোম্পানি যেমন প্রোটন, নর্ডভিপিএন এবং উইন্ডস্ক্রাইব জানিয়েছে, তাদের ডাউনলোড ও সাইন-আপের হার কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। প্রোটন ভিপিএন জানিয়েছে, নতুন আইন চালু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাদের সাইন-আপ ১৪০০ শতাংশ বেড়ে যায়। একাধিক অ্যাপ স্টোরেও ভিপিএন অ্যাপগুলো শীর্ষ ১০-এ উঠে আসে।
এই প্রবণতা শুধু পশ্চিমা দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। যেসব দেশে অনলাইনে সেন্সরশিপ বা প্ল্যাটফর্ম নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেখানে এ ধরনের বিধিনিষেধ এলেই ভিপিএনের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট
ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পর্যায়ে বাধ্যতামূলক বয়স যাচাই আইন চালু না হলেও, ‘সংবেদনশীল’ ওয়েবসাইট বা কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে তাদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অনেক সময় কিছু ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া হয় সামাজিক নীতিমালার দোহাই দিয়ে, আবার কখনো প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ব্যবহার করে কিছু বিষয়বস্তুতে প্রবেশ সীমাবদ্ধ করা হয়।
এ ধরনের পরিবেশে ভিপিএন হয়ে উঠেছে ‘নিরাপদ’ ইন্টারনেট ব্যবহারের এক বিকল্প উপায়। বিনোদন, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য, বা আন্তর্জাতিক সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ—এসব কিছুই অনেক ক্ষেত্রে ভিপিএনের সাহায্যে সহজ হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অঞ্চলের তরুণদের মধ্যে ভিপিএনের ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, তারা অনেক সময়ই জানে না তাদের তথ্য কোন ঝুঁকিতে পড়তে পারে কিংবা কোন কোন ভিপিএন আসলে নিরাপদ নয়।
প্রযুক্তিগত সমাধান না সামাজিক সমাধান?
গোপনীয়তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের সুরক্ষার নামে যত বেশি আইডি যাচাই বাধ্যতামূলক করা হবে, ততই ইন্টারনেট হবে নজরদারি এবং তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের প্রযুক্তিবিদ ড্যানিয়েল কান গিলমোর বলেন, “সবাই চায় একটা ‘দ্রুত সমাধান’। কিন্তু এগুলোর ফলাফল নিয়ে কেউ ভাবছে না।”
তিনি বলেন, সমস্যার আসল সমাধান প্রযুক্তি নয়, বরং সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি, পারিবারিক যোগাযোগ, এবং কিশোরদের মানসিক সহায়তার মাধ্যমে করা উচিত।
গোপনীয়তা বনাম প্রবেশাধিকার: ভবিষ্যতের লড়াই
এই মুহূর্তে পুরো বিশ্ব এক দোটানার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে: একদিকে শিশুদের রক্ষা করার চাপ, অন্যদিকে মুক্ত এবং ব্যক্তিগত ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকার। ভিপিএন এখন শুধু প্রযুক্তিপ্রেমীদের জন্য নয়—বরং সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যেও এটি ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে এই জনপ্রিয়তার মধ্যেই শুরু হয়েছে ভিপিএনের ওপর নতুন ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি—ফলে